রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরুষ শিক্ষকের বিরুদ্ধে নারী শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অনেক অভিযোগ তদন্তের পর আর আলোর মুখ দেখে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নির্যাতন–সংক্রান্ত অভিযোগ কমিটি অনেক অভিযোগ তদন্ত করে উপাচার্যের কাছে পাঠালেও তা সিন্ডিকেটে পৌঁছায় না। বিচার না করে অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগকারী শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের বিরুদ্ধে উল্টো নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করা হয়। আজ বুধবার বিকেলে রাজধানীতে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এসব অভিযোগ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে মোজাফ্ফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে ‘নারীবিদ্বেষী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন: বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি, নিপীড়ন ও উত্ত্যক্তকরণ প্রতিরোধে করণীয়’ শিরোনামে এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। সভায় বক্তারা সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগীয় সভায় এক নারী শিক্ষকের প্রতি পুরুষ শিক্ষকের যৌন নিপীড়নমূলক আচরণের প্রসঙ্গ টেনে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। যৌন নিপীড়ন বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি সক্রিয় করা এবং এ–সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করার ওপর জোর দেন তাঁরা।
সভায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যা (যৌন নিপীড়ন) ঘটেছে, তা ন্যক্কারজনক। এসবের সঙ্গে বিপথগামী কিছু শিক্ষক ও শিক্ষার্থীও যুক্ত হয়েছেন। সুন্দর সমতার সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি নয়, মানবিকতার সংস্কৃতি লাগবে।
সভায় মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক ইয়াসমীন হক। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত যৌন নির্যাতন–সংক্রান্ত অভিযোগ কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসা এই শিক্ষক বলেন, ‘উপাচার্য কে—তার ওপর যৌন নিপীড়নের বিচার পাওয়া না পাওয়াটা নির্ভর করে। উপাচার্যদের নিজেদের ক্যাডারের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলে তদন্ত প্রতিবেদন সিন্ডিকেটে আর পাঠান না।’ ৩০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদনের বিষয়ে ব্যবস্থা না নিলে উপাচার্যের বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ার সুযোগ থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কিন্তু কে যাবে রিট করতে? শিক্ষক সমিতিরও অ্যাজেন্ডা থাকে।’
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রভাব খাটিয়ে যৌন নির্যাতনসংক্রান্ত অভিযোগ কমিটিগুলোকে অকার্যকর করার চেষ্টা হয় বলে উল্লেখ করেন ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এ কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করা মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান মাহবুবা কানিজ। দুটো অভিযোগের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, একটি অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন ৯ মাসেও সিন্ডিকেটে যাচ্ছিল না। আরেক শিক্ষকের ক্ষেত্রে পেছনের তারিখে সই করে অবসরের সুবিধাদি দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল।
অনেক চেষ্টায় ওই দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়েছিল উল্লেখ করে মাহবুবা কানিজ বলেন, ‘শিক্ষক হয়েও অনেকে লোভ, প্রলোভনের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন না। কমিটিগুলোকে অকার্যকর করার চেষ্টা করা হয়। শিক্ষক সমিতিকেও কোনো ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় না।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানির মাধ্যমে নারীদের বিরুদ্ধে রাজনীতি করা হচ্ছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক সাদেকা হালিম। তিনি বলেন, যে নারী অভিযোগ করেন, অনেক সময় তাঁর দিকেই অভিযোগের আঙুল তোলা হয়। একটি অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটিতে দেড় বছর ধরে আটকে আছে। বিচারের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা অপেক্ষা করেন, যেন মেয়েটি মাস্টার্স পাস করে চলে যান। তাঁরা মনে করেন, ছাত্রীর বিদায়, যৌন হয়রানির মামলারও বিদায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক প্রভাবই যৌন নির্যাতনসংক্রান্ত অভিযোগ কমিটির কাজে সবচেয়ে বড় প্রভাব ফেলে। নানা চাপ, বাহাস এতে যুক্ত থাকে। এসব চাপ থেকে মুক্ত হতে না পারলে কমিটি থেকে বিচার পাওয়া সম্ভব নয়। আর বিচার না হলে শিক্ষক–শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করতে উৎসাহ পাবেন না।
সব ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব ও ক্ষমতার ঊর্ধ্বে উঠে যৌন নির্যাতনের অভিযোগগুলোর তদন্ত ও বিচার হওয়া দরকার বলে উল্লেখ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খন্দকার ফারজানা রহমান। তিনি বলেন, শিক্ষক হয়েও অনেকে সচেতন নন যে একজন নারীর সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করতে হবে।
রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে কোনো কোনো অভিযোগ বাধাগ্রস্ত হয় বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি নিজাম উদ্দিন ভূইয়াও। তিনি বলেন, কিছু অভিযোগে রাজনীতি চলে আসে। কেউ না কেউ প্রভাব ফেলে।
কমিটিগুলো সক্রিয় থাকলে যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ করা সম্ভব বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নির্যাতনসংক্রান্ত অভিযোগ কমিটির সভাপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক জেবউননেছা। তিনি বলেন, গত ১৪ মাসে তিনি ১২টি অভিযোগ পেয়েছেন এবং সবগুলোই নিষ্পত্তি করা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কোনো দিন বিচার স্থগিত করার কথা বলেননি।
মতবিনিময় সভায় লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড সম্পাদক রেখা সাহা। তিনি বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন সহিংসতার ক্ষেত্রে শুধু শিক্ষার্থীরা নন, বরং যাঁরা সমাজ গড়ার কারিগর, নতুন প্রজন্ম গড়ার কারিগর; সেই শিক্ষক সমাজের কিছু এই অপরাধের সঙ্গে যুক্ত।
সভায় সভাপতির বক্তব্যে সংগঠনের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, শিক্ষাঙ্গনে যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধের ঘটনায় অভিযোগ কমিটি হলেই কাজ শেষ হয়ে যায় না। শিক্ষকদেরও দায় আছে। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে।
স্বাগত বক্তব্যে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, নারীরা বহুমাত্রিক বিপন্নতার মুখোমুখি হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও এখন যৌন নিপীড়নের কুৎসিত বিষয়টি দেখা যায়।
সভায় আরও বক্তব্য দেন ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নির্যাতনসংক্রান্ত অভিযোগ কমিটির সভাপতি শরীফা সুলতানা, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সিউতি সবুর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী রিফাত হোসেন ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সজীব হাওলাদার মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন।
সভাটি সঞ্চালনা করেন সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুদা রেহানা বেগম।