জুলাই অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর একটি অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতার ভিত্তি হলো, ‘প্রয়োজনীয়তা, জনগণের চাহিদা এবং জনগণের সার্বভৌমত্ব।’
অন্তর্বর্তী সরকার গঠন ও শপথ পাঠের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা রিট খারিজের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিলের (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) শুনানির পর সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন আইনজীবীরা।
মঙ্গলবার (০২ ডিসেম্বর) প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চে এই শুনানি হয়।
গত বছরের ৫ আগস্ট পদত্যাগের করে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দেন এবং রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন অন্তর্বর্তী সরকার গঠন বিষয়ে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের কাছে মতামত চেয়ে রেফারেন্স পাঠান।
সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টের উপদেষ্টামূলক এখতিয়ারের বিষয়ে বলা আছে। অনুচ্ছেদটি বলছে, যদি কোনো সময়ে রাষ্ট্রপতির নিকট প্রতীয়মান হয় যে, আইনের এইরূপ কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে বা উত্থাপনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, যা এমন ধরনের ও এমন জনগুরুত্বসম্পন্ন যে, সেই সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের মতামত গ্রহণ করা প্রয়োজন, তা হলে তিনি (রাষ্ট্রপতি) প্রশ্নটি আপিল বিভাগের বিবেচনার জন্য প্রেরণ করতে পারবেন এবং ওই বিভাগ স্বীয় বিবেচনায় উপযুক্ত শুনানির পর প্রশ্নটি সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে স্বীয় মতামত জ্ঞাপন করতে পারবেন।
রাষ্ট্রপতির বিশেষ রেফারেন্সের (১/২৪) পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বিভাগ গত বছরের ৮ আগস্ট মতামত দেন। অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য শোনা হয়। মতামতে বলা হয়, রাষ্ট্রের সাংবিধানিক শূন্যতা পূরণে জরুরি প্রয়োজনে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের নির্বাহী কার্য পরিচালনার নিমিত্ত অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা ও অন্যান্য উপদেষ্টা নিযুক্ত করতে পারবেন। রাষ্ট্রপতি ওইরূপ নিযুক্ত প্রধান উপদেষ্টা ও অন্যান্য উপদেষ্টাদের শপথ পাঠ করাতে পারবেন।
এর বৈধতা নিয়ে আইনজীবী মোহাম্মদ মহসিন রশিদ গত বছরের ডিসেম্বরে রিট করেন। চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি দেওয়া বিচারপতি ফাতেমা নজীব ও বিচারপতি শিকদার মাহমুদুর রাজীর হাইকোর্ট বেঞ্চ রিট খারিজ করে দেন। রায়ে হাইকোর্ট বলেন, ‘বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কোনো আইনি দলিল দিয়ে সমর্থিত নয় বলে রিট আবেদনকারীর বক্তব্যে এসেছে। উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এক অনন্য পরিস্থিতিতে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুয়ায়ী উপদেষ্টামূলক মতামত গ্রহণ করেন। মতামত অনুযায়ী কাজ করেছেন। তাই এটি আইনি দলিল দিয়ে সমর্থিত, বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার দ্বারা সমর্থিত। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে যে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছিল, তা আমাদের ইতিহাসের অংশ এবং আশা করি আগামী বহু বছর ধরে জনগণ যত্নে থাকবে।’
রিটটি ভ্রান্ত ধারণা, বিদ্বেষপ্রসূত ও হয়রানিমূলক বলে উল্লেখ করে তা সরাসরি খারিজ করা হয়।
পরে এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি চেয়ে (লিভ টু আপিল) আবেদন করেন রিট আবদনকারী মোহাম্মদ মহসিন রশিদ।
মঙ্গলবার আবেদনকারী আইনজীবীর শুনানির পর ইন্টারভেনার হিসেবে শুনানি করেন সুপ্রিম কোর্টের তিন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী। তারা হলেন— আইনজীবী ড. শরীফ ভূঁইয়া, রুহুল কুদ্দুস কাজল ও মোহাম্মদ শিশির মনির।
পরে আইনজীবী শরীফ ভুঁইয়া সাংবাদিকদের বলেন, সাংবিধানিক প্রয়োজনীয়তা বলে একটি তত্ত্ব আছে, এটাও আমাদের সাংবিধানিক আইনের অংশ। যদি কোনো সময় গভীর সাংবিধানিক সংকট বা শূন্যতা তৈরি হয়, তখন সেই শূন্যতা পূরণ করতে হবে। একটি রাষ্ট্র আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত রাষ্ট্র হতে হলে তার একটি সরকার থাকতে হয়। গত বছর ৫ আগস্ট থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত আমরা সরকারবিহীন ছিলাম। কিন্তু একটা দেশ তো সরকারবিহীনভাবে চলতে পারে না। ফলে আমাদের একটা সরকারের দায়িত্ব নেওয়া প্রয়োজন ছিল।’
তখন এক সাংবাদিক জানতে চান, তাহলে কি সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে আপিল বিভাগের মতামত নেওয়ার প্রয়াজন ছিল না? জবাবে শরীফ ভুঁইয়া বলেন, ‘১০৬ অনুচ্ছেদের ভিত্তিতে এই সরকারের সাংবিধানিকতা নির্ধারণ করা অসম্ভব। কারণ ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে যে মতামত দেয়া হয়েছে, সেটি ছোট্ট একটা মতামত। এখানে মূল কথা একটাই, রাষ্ট্রপতি চাইলে প্রধান উপদেষ্টা এবং উপদেষ্টাদের শপথ পড়াতে পারেন। এটা দিয়ে তো দেড় বছরের শাসন ব্যবস্থা ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। এই সরকারকে ব্যাখ্যা করার জন্য ১০৬ এর কোনো প্রয়োজন নাই। এই সরকারকে ব্যাখ্যা করতে হবে আমরা জনগণ কী চেয়েছি, গত দেড় বছর ধরে আমরা কী করছি এবং আমরা ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কী করব, তা দিয়ে। কাজেই এই সরকারের বৈধতার ভিত্তি হলো প্রয়োজনীয়তা, জনগণের চাহিদা এবং জনগণের সার্বভৌমত্ব।’
আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘গত বছরের ৭ আগস্ট ইস্যুকৃত একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি থেকে আমি আদালতকে দেখিয়েছি, ৫ আগস্ট বঙ্গভবনে তিন বাহিনীর প্রধান এবং বিএনপি-জামায়াতে ইসলামিসহ অন্যান্য ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দল এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে সেদিনই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। বর্তমান আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলও সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। সিদ্ধান্ত হয়েছিল, একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হবে। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যে সমস্ত রাজনৈতিক দল, সংগঠন, ব্যক্তি একাট্টা ছিল, তাদের সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে এই অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাহী বিভাগে অন্তর্ভুক্ত একজন ব্যক্তি। রাষ্ট্রপতির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের যে সিদ্ধান্ত হয়েছে। ফলে অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধানসম্মত।’
আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, ‘১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে যদি রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের মতামত না নিতেন, তাহলেও অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করার কোনো সুযোগ নাই।