চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) এখন একটি বিষয়ে সতর্ক, সেটি হচ্ছে স্টারলিংক। একগুচ্ছ কৃত্রিম উপগ্রহ আকাশে পাঠিয়ে সেখান থেকে স্টারলিংকের মাধ্যমে উচ্চগতির ইন্টারনেট সরবরাহ করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স এই কাজ করছে। তবে মার্কিন সরকার এখান থেকে নিশ্চিত সুবিধা নিচ্ছে বলে সতর্ক করেছে পিএলএ। লিবারেশন আর্মি ডেইলিতে এমন তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।
গত বছর ইউক্রেনে স্টারলিংক সুবিধ চালু করা হয়। রুশ বাহিনী ইউক্রেনে হামলা শুরুর পর স্পেসএক্সের কাছে সহযোগিতা চায় ইউক্রেন। পিএলএর সংবাদপত্রে একে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়, এই প্রযুক্তি তাদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে পারে।
ইউক্রেন যুদ্ধে কিয়েভ বাহিনীর জন্য স্টারলিংক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কৃত্রিম উপগ্রহের এই সুবিধা সেনাসদস্যদের মধ্যে যোগাযোগ, লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত ও বিভিন্ন ঘটনার ভিডিও অনলাইনে আপলোড করে সারা বিশ্বে দ্রুত ছড়িয়ে দিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে আসা এই ইন্টারনেট সুবিধা সহজে জ্যাম করা যায় না।
২০২১ সালে স্টারলিংকের দুটি কৃত্রিম উপগ্রহ চীনের মহাকাশ স্টেশনের সঙ্গে প্রায় সংঘর্ষে জড়াতে যাচ্ছিল। ওই সময় কৃত্রিম উপগ্রহ দুটি সরিয়ে নিতে হয়। চীনের অভিযোগ অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র অস্বীকার করে।
চীনের মতে, স্টারলিংকের এই সুবিধা তাদের মিত্র রাশিয়ার জন্য একদিকে যেমন অসুবিধা সৃষ্টি করেছে, তেমনি উদ্বেগও সৃষ্টি করেছে। কারণ, প্রয়োজনে তাইওয়ান এ সুবিধা নিতে পারে। তাইওয়ান দ্বীপটিকে চীন নিজেদের অংশ বলে মনে করে। তবে তাইওয়ান নিজেকে স্বাধীন মনে করে। চীনের আশঙ্কা, তাইওয়ান স্টারলিংকের সুবিধা পেলে প্রয়োজনে তাইওয়ান আক্রমণ করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে।
তাইওয়ান ছাড়াও স্টারলিংক ঘিরে চীনের আরও উদ্বেগ রয়েছে। তাদের আশঙ্কা, স্টারলিংকের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র আকাশের নিম্ন এলাকায় বিভিন্ন এলাকা দখল করছে। তাই চীনও ওই ক্ষেত্রে তাদের ক্ষমতা দেখাতে চায়। স্টারলিংক ব্যবস্থার সুবিধা নিতে চীনও সেই পথে হাঁটতে চলেছে। তাই স্টারলিংকের মতোই নিজস্ব কৃত্রিম উপগ্রহগুচ্ছ আকাশে পাঠাতে শুরু করেছে তারা।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, চীন কখনো তাইওয়ান আক্রমণ করলে সবার আগে সমুদ্রের নিচে থাকা ১৪টি ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেবে। তাইওয়ান নিজেদের এ দুর্বলতা জানে। তারা এ ক্ষেত্রে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। প্রায় ৭০০টি স্থানে অ্যানটেনা বসিয়ে তা পরীক্ষা করে দেখছে তাইপে। কিছু অ্যানটেনা তাইওয়ানের বাইরেও বসানো হচ্ছে। এসব অ্যানটেনা নিম্ন কক্ষপথে থাকা কৃত্রিম উপগ্রহে সংকেত আদান–প্রদান করতে পারবে। স্টারলিংক মূলত এ ধরনের কাজ করে থাকে। কোনো আক্রমণে যাতে এসব অ্যানটেনা ধ্বংস না হয়, তার ব্যবস্থাও রাখা হচ্ছে। তাইওয়ানের জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষক জেং ইসুও এ তথ্য জানিয়েছেন।
দুই পরাশক্তি ভিন্ন পদ্ধতিতে কক্ষপথের হিসাব করবে। মহাকাশের স্বস্তির বিষয় নিয়েও তাদের মতপার্থক্য থাকতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে দুই পক্ষের মধ্যে যোগাযোগের ঘাটতি।
বেঞ্জামিন সিলভারস্টেইন, বিশ্লেষক, কার্নেগি এনডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস
চীনের অবশ্য ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে কৃত্রিম উপগ্রহ ধ্বংস করার সক্ষমতা আছে। তবে স্টারলিংক ৪ হাজার কৃত্রিম উপগ্রহের একটি গুচ্ছ। প্রতিষ্ঠানটি ১০ হাজারের বেশি কৃত্রিম উপগ্রহ কক্ষপথে পাঠাতে চায়। তবে স্পেসএক্সের প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্ককে নমনীয় রেখে চীন আরও সুবিধা আদায় করতে পারে। তারা তাইওয়ানকে স্টারলিংকের সুবিধা দেওয়া বন্ধে ইলন মাস্ককে চাপ দিতে পারে। কারণ, তাঁর গাড়িনির্মাণ প্রতিষ্ঠান টেসলার বিশাল কারখানা চীনের সাংহাইতে অবস্থিত।
গত বছর ইলন মাস্ক তাইওয়ানের ওপর চীনের নিয়ন্ত্রণ রাখতে আরও বেশি সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
তবে তাইওয়ান অন্যের ওপর নির্ভরতা কমাতে চাইছে। তাদের নিজস্ব মহাকাশ সংস্থা নিম্ন কক্ষপথের উপযোগী যোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত কৃত্রিম উপগ্রহ তৈরি করছে। ২০২৫ সালে তাদের প্রথম উপগ্রহ পাঠানো হতে পারে।
তবে তাইওয়ানের তুলনায় চীনের নিম্ন কক্ষপথ নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার লক্ষ্য আরও বড়। ২০২০ সালে জাতিসংঘের সংস্থা আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নে জমা দেওয়া নথি অনুযায়ী, ১২ হাজার ৯৯২ কৃত্রিম উপগ্রহের গুচ্ছ তারা তৈরি করবে। ওই নথি জমা দেওয়ার পরের বছর চীন সরকার চায়না স্যাটেলাইট নেটওয়ার্কস গ্রুপ লিমিটেড তৈরি করে। তারা কৃত্রিম উপগ্রহ তৈরির কাজ করছে। কমপক্ষে সাতটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিগত মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এসব কৃত্রিম উপগ্রহ কারখানা তৈরি করছে। প্রতিবছর তারা কয়েক শ কৃত্রিম উপগ্রহ সরবরাহ করতে পারবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বেইজিংয়ের কর্মকর্তারা ইতিমধ্যে মহাকাশে অন্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতার আভাস দিয়েছেন। গত বছর লিবারেশন আর্মি ডেইলি সতর্ক করে বলে, নির্দিষ্ট কক্ষপথ ও রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির বিষয়টি কৌশলগত সম্পদ। এখানে একচ্ছত্র আধিপত্য দেখানোর চেষ্টা করছে স্টারলিংক। গত বছর চীনের মহাকাশবিষয়ক সংস্থার চেয়ারম্যান ইউ ইয়ানশেং বলেন, মহাকাশে পরাশক্তি হতে হলে চীনকে দ্রুত অগ্রসর হতে হবে। গত এপ্রিলে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেছিয়াং তিনটি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানে যান।
এর মধ্যে একটি হচ্ছে কৃত্রিম উপগ্রহ নির্মাতা গ্যালাক্সি স্পেস। গত বছর প্রতিষ্ঠানটি ছয়টি কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করেছে।
চীনের মহাকাশ দৌড়ের মূল উৎসাহদাতা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। তিনি পিপলস লিবারেশন আর্মিকে আধুনিকায়নের ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁর জেনারেলরা দীর্ঘদিন ধরেই মার্কিন তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করছেন। সি এখন অত্যাধুনিক ‘তথ্যসমৃদ্ধ’ একটি বাহিনী গড়তে চান। এ বাহিনীর কাজ হবে তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে জল, স্থল ও আকাশপথে যৌথ অভিযান চালানো। এ ছাড়া মহাকাশ ও সাইবার দুনিয়ার সবকিছুতেই তারা এগিয়ে থাকবে।
নিম্ন কক্ষপথে স্পেসএক্স ছাড়াও চীনের আরও প্রতিদ্বন্দ্বী থাকছে। ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্য সরকার ওয়ানওয়েব নামের উদ্যোগ নিয়েছে। তারা ৬৫০টি কৃত্রিম উপগ্রহ নিম্নকক্ষপথে পাঠাচ্ছে। এ ছাড়া আমাজনের জেফ বেজোস কুইপার নামের একটি উদ্যোগ নিয়েছে। শিগগিরই তাদের পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু হবে। এর বাইরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিজস্ব ব্যবস্থা তৈরি করবে। রাশিয়াও এ দৌড়ে পিছিয়ে নেই। বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো স্যাটেলাইট ইন্টারনেটকে তাদের কৌশলগত সক্ষমতা হিসেবে দেখছে।
স্পেসএক্সের গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা আছে। কৃত্রিম উপগ্রহ আকাশে বেশি দিন থাকে না। তাই নিয়মিত এগুলো পরিবর্তন করতে হয়। এ জন্য অনেক রকেট উৎক্ষেপণ প্রয়োজন। স্পেসএক্সের অবশ্য নিজস্ব রকেট উৎক্ষেপণ ব্যবস্থা ও রকেট রয়েছে। তারা ফ্যালকন ৯ নামে একাধিকবার ব্যবহারযোগ্য রকেট তৈরি করেছে। এখন তারা স্টারশিপ নামে বিশাল এক রকেট তৈরি করছে, যা একবারে শতাধিক কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করতে পারবে।
মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম চীনকে দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। পিএলএ ডেইলির অভিযোগ, নিম্নকক্ষপথে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠানো যাবে। এতে স্টারলিংক একাই ৮০ শতাংশ জায়গা দখল করে নিতে পারে।
যুক্তরাজ্যের গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের জুলিয়ানা সুয়েস বলেন, হিসাব অত সোজাসাপ্টা নয়। নিম্ন কক্ষপথকে একটি সড়ক হিসেবে বিবেচনা করুন। এখানে হিসাব করতে হবে কতগুলো গাড়ি সেখানে নিরাপদে যাতায়াত করতে সক্ষম। এর অধিকাংশ নির্ভর করে কৃত্রিম উপগ্রহের আকার ও তাদের কক্ষপথের ওপর।
২০২১ সালে স্টারলিংকের দুটি কৃত্রিম উপগ্রহ চীনের মহাকাশ স্টেশনের সঙ্গে প্রায় সংঘর্ষে জড়াতে যাচ্ছিল। ওই সময় কৃত্রিম উপগ্রহ দুটি সরিয়ে নিতে হয়। চীনের অভিযোগ অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র অস্বীকার করে।
মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান কার্নেগি এনডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের বিশ্লেষক বেঞ্জামিন সিলভারস্টেইন বলেন, দুই পরাশক্তি ভিন্ন পদ্ধতিতে কক্ষপথের হিসাব করবে। মহাকাশের স্বস্তির বিষয় নিয়েও তাদের মতপার্থক্য থাকতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে দুই পক্ষের মধ্যে যোগাযোগের ঘাটতি। এর আগে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র এ নিয়ে আলোচনা করত। কিন্তু ২০১৭ সালের পর থেকে আর কোনো বৈঠক হয়নি। এটাই বিপজ্জনক। নিম্ন কক্ষপথে যত জট বাড়ছে সংঘর্ষের আশঙ্কা ততই বেড়ে যাচ্ছে।
দ্য ইকোনমিস্ট অবলম্বনে মো. মিন্টু হোসেন