যে কারণে বন্ধু হলেন ভয়ংকর খুনি

যে কারণে বন্ধু হলেন ভয়ংকর খুনি

বন্ধুকে পরকীয়া থেকে ফেরাতে গিয়ে নিজেই জড়িয়ে যান প্রেমের ফাঁদে। তারপর প্রেমিকার অতি সান্নিধ্য পেতে গিয়ে অবশেষে বন্ধুর হাতেই পিলে চমকানো খুনের শিকার হন। রাজধানীার আলোচিত হত্যাকাণ্ড ‘২৬ টুকরো লাশ’ রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অনুসন্ধানে এমন রোমহর্ষক তথ্য বের হয়ে এসেছে।

ঢাকার হাইকোর্টের সামনে প্লাস্টিকের ড্রামের ভেতর থেকে আশরাফুল হক নামে রংপুরের এক ব্যবসায়ীর খণ্ডিত লাশ উদ্ধারের ঘটনায় গ্রেপ্তার প্রধান সন্দেহভাজন জরেজের ভাষ্যমতে এমন তথ্য বের হয়ে এসেছে বলে জানিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ।

ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার শফিকুল ইসলাম বলেন, মালয়েশিয়া প্রবাসী জরেজ মাস দেড়েক আগে দেশে ফেরেন। সেখানে থাকা অবস্থায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কুমিল্লার শামীমার পরিচয় হয় এবং তাদের মধ্যে সম্পর্ক হয়। জরেজের দেশে ফেরার দিন শামীমাই তাকে ঢাকার বিমানবন্দরে রিসিভ করেন এবং পরে যে যার বাড়ি চলে যান।

দেশে ফেরার পর তাদের মধ্যে চলতে থাকা যোগাযোগের বিষয়টি জরেজের স্ত্রী ‘ধরে ফেলেন’। আর এ বিষয়ে সহায়তার জন্য তিনি দ্বারস্থ হন জরেজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আশরাফুলের।

ডিবির এ কর্মকর্তা বলেন, জরেজের স্ত্রী আশরাফুলকে শামীমার নাম্বার দেন। তাকে ফোন করে যেন তার স্বামীর জীবন থেকে সরে যেতে বলেন সেই অনুরোধ করেন। এরমধ্যে আশরাফুল শামীমাকে ফোন দেয়, একসময় তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে প্রেমে পড়ে যায় আশরাফুল। আশরাফুল ও শামীমা নিয়মিত কথা বলতেন ও ভিডিও চ্যাটিং করতেন।

এরমধ্যে আশরাফুল ও শামীমা পরিকল্পনা করে জরেজকে জাপানে পাঠিয়ে দেবে, এরমধ্যে তারা দুইজনের জাপান যাওয়ার খরচ ৭ লাখ করে ১৪ লাখ দেবেন। জাপান যাওয়ার প্রক্রিয়া এবং টাকা নেওয়ার জন্য শামীমা তাদেরকে ঢাকায় যেতে বলেন, সে অনুযায়ী দুই বন্ধু মিলে গত মঙ্গলবার ঢাকায় রওনা দেন। পরদিন সকালে তাদেরকে সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডে রিসিভ করেন শামীমা। এরপর তারা শনির আখড়ায় একটি ভাড়া বাসায় উঠেন।

শফিকুল ইসলাম আরও বলেন, নিজেরা একান্তে সময় কাটাতে আশরাফুলকে জুসের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাওয়ায় জরেজ ও শামীমা, কিন্তু সে ঘুমায় না। আশরাফুল বারবার শামীমার সান্নিধ্যে যেতে চেষ্টা করে, এতে জরেজ বাধা দেয়। এ নিয়ে তাদের মধ্যে তর্কাতর্কি হয়। একপর্যায়ে জরেজ বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার সময় দেখতে একইরকম হওয়ায় ভুলে আশরাফুলের মোবাইল নিয়ে বেরিয়ে যায়। সে বাড়ি চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও মোবাইল নিতে আবার বাসায় ফেরত যায়।

ডিবিপ্রধান বলেন, জরেজ বাসায় ঢুকলে শামীমা তাকে ভেতরে যেতে বলে এবং আশরাফুল ঘুমিয়ে গেছে বলে জানায়। ঘুমিয়েছে কিনা দেখার জন্য শামীমা আশরাফুলের গায়ে হাত দিলে সে জেগে যায়। তখন জরেজ আড়ালে লুকিয়ে থাকে।

শামীমাকে বিকৃত যৌনাচারের জন্য জোর করতে থাকে আশরাফুল, তখন শামীমা প্রলোভন দেখিয়ে দড়ি দিয়ে তার হাত বেঁধে ফেলে। এরমধ্যে শামীমা চিৎকার করলে জরেজ বের হয়ে এসে হাতুড়ি দিয়ে আশরাফুলের হাঁটুতে আঘাত করে। সে চিৎকার করতে থাকলে শামীমা তার মুখে ওড়না ঢুকিয়ে দিয়ে স্কচটেপ লাগিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পর দেখে আশরাফুল আর নড়াচড়া করছে না, তখন তারা বুঝতে পারে আশরাফুল মারা গেছে।

তারা এ অবস্থায় লাশটা নিয়ে রাতে এক বাসায় থাকে, নানা পরিকল্পনার পর বৃহস্পতিবার সকালবেলা বাইরে থেকে ড্রাম এবং অন্যান্য জিনিস কিনে আনে। লাশটি ২৬ টুকরা করে ড্রামে ভরে ওপরে চাল দিয়ে ঢেকে দেয়। এরপর সিএনজিতে করে এসে হাইকোর্টের সামনে ড্রাম দুটি রেখে, তারা সায়েদাবাদ চলে যায়। সেখান থেকে শামীমা নিজের বাড়ি লাকসামে চলে যায় এবং জরেজ দাউদকান্দিতে তার পূর্ব পরিচিত একজনের বাড়িতে গিয়ে ওঠে, যেখান থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে ডিবি।

এর আগে জরেজের প্রেমিকা শামীমা আক্তারকে গ্রেপ্তারের পর শনিবার সকালে সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব জানিয়েছিল, প্রেমিকাকে দিয়ে ‘ফাঁদে ফেলে’ আশরাফুলের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা আদায়ের পরিকল্পনা ছিল জরেজের। সে পরিকল্পনায় আশরাফুলকে ঢাকায় আনার কথা র‌্যাবকে জানিয়েছেন শামীমা। কিন্তু টাকা আদায় না করে কেন তাকে খুন করা হল, সেটির ‘স্পষ্ট ধারণা’ পাওয়া যায়নি।

তখন হত্যাকাণ্ডের ‘মোটিভ’ নিশ্চিত হতে জরেজের বক্তব্যের জন্য অপেক্ষা করতে বলেছিল র‌্যাব, যাকে শুক্রবার রাতে কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে গ্রেপ্তার করে ডিবি।

শনিবার (১৫ নভেম্বর) দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে জরেজকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবিপ্রধান) মো. শফিকুল ইসলাম বলেছেন, এটা আসলে একটা ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনী।

গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় হাইকোর্ট সংলগ্ন জাতীয় ঈদগাহ মাঠের গেটের কাছে নীল ড্রাম থেকে খণ্ড-বিখণ্ড লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

২৬ টুকরো লাশের প্রথমে পরিচয় পাওয়া না গেলেও আঙুলের ছাপ নিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের ডেটাবেইজ থেকে পরিচয় শনাক্ত করা হয়। লাশটি রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের নয়াপাড়া গ্রামের আশরাফুল হকের।

এ ঘটনায় শুক্রবার (১৪ নভেম্বর) শাহবাগ থানায় একটি মামলা করেন নিহতের বোন। এ হত্যাকাণ্ডে নিহতের ‘বন্ধু’ জরেজ নামে একজনকে ‘প্রধান সন্দেহভাজন’ হিসেবে খোঁজার কথা বলেছিল পুলিশ।

রাতেই ডিবি পুলিশ জরেজকে এবং র‌্যাব জরেজের প্রেমিকা শামীমাকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানিয়েছে।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023 EU BANGLA NEWS