বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে বার বার ঘটছে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। এতে পুড়ছে বিস্তীর্ণ বনভূমির গাছপালাসহ বিভিন্ন লতা-গুল্ম।প্রায় প্রতি বছরই আগুন লাগছে। গত দুই যুগে অন্তত ২৬ বার আগুন লেগেছে সুন্দরবনে। আগুন লাগার পর কারণ অনুসন্ধান, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তবে সেসব তদন্ত প্রতিবেদন ও দুর্ঘটনা এড়াতে করা সুপারিশগুলো আলোর মুখ দেখেনি। ফলে থামছে না সুন্দরবনে অগ্নিকাণ্ড।
সবশেষ শনিবার (২২ মার্চ) দুপুর ১২টার দিকে সুন্দরবনের কলমতেজী টহল ফাঁড়ি এলাকায় আগুন লেগেছে। বনের টেপারবিল এলাকা থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখেন বনসংলগ্ল এলাকার বাসিন্দারা। পরে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে নিয়ে বন বিভাগ আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে।
বিকেলের দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছায় ফায়ার সার্ভিসের ৫টি ইউনিট। ফায়ার সার্ভিস, বন বিভাগ ও স্থানীয়রা সুন্দরবনে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে বনের মধ্যে প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকা ধরে ফায়ার লাইন (শুকনো পাতা, মাটি সরিয়ে নালা) করা হয়েছে। তবে কাছাকাছি পানির উৎস্য না থাকায় শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ওই এলাকায় পানি দেওয়া যায়নি। গ্রীষ্ম মৌসুম চলায় অনেকদিন বৃষ্টি না হওয়া ও শুকনো পাতা জমে যাওয়ার কারণে আগুন অনেকক্ষণ ধরে জ্বলছে। আগুন লাগলে তাত্ক্ষণিক সাড়া দেওয়ার মতো যন্ত্রপাতি ও জনবল নেই বন বিভাগের।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের শরণখোলা স্টেশনের কর্মকর্তা আফতাদ-ই-আলম বলেন, দেড় কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ফায়ার লাইন কাটা হয়েছে। আগুন আশা করা যায় আর ছাড়াবে না। কোথাও ধোঁয়া আছে, কোথাও এখনও একটু একটু করে জ্বলছে। আলো না থাকায় রাতে কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। আর্ধেকটা পথ পর্যন্ত পাইপ টেনে নেওয়া গেছে। তবে পানি দেওয়া যায়নি। পাইপ টেনে সকাল থেকে পানি দেওয়া যাবে বলে জানান তিনি।
প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বনাঞ্চলে ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখার পর বন বিভাগ ও স্থানীয় বাসিন্দারা মিলে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করেন। বন বিভাগের সাথে স্বেচ্ছাসেবকসহ শত শত স্থানীয় বাসিন্দা আগুন নিয়ন্ত্রণে বনের মাঝে ফায়ার লাইন কাটার কাজ করেছেন। তবে কাছাকাছি কোনো নদী-খাল না থাকায় সেখানে সন্ধ্যা পর্যন্ত পানি দেওয়ার কাজ শুরু করা যায়নি। রাতেও বনের মধ্যে বেশ কয়েকটি স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে আগুন ও ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা গেছে।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মুহাম্মদ নুরুল করিম বলেন, আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার কারণ নেই। আগুন ততটা বেশি না, বেশি হলো ধোঁয়া। আগুন যেন আর না ছড়ায় এজন্য চারপাশ থেকে পাতা সরিয়ে সরু নালা করা হয়েছে। পাইপ এখনও ওই এলাকা পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। আশা করি রোববার (২৩ মার্চ) সকালে আরও গতি নিয়ে কাজ করা যাবে।
দুই যুগে ২৬ বার আগুন সুন্দরবনে
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০০২ সালে সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের কটকায় একবার, একই রেঞ্জের নাংলী ও মান্দারবাড়িয়ায় দুইবার, ২০০৫ সালে পচাকোড়ালিয়া, ঘুটাবাড়িয়ার সুতার খাল এলাকায় দুইবার, ২০০৬ সালে তেড়াবেকা, আমুরবুনিয়া, খুরাবাড়িয়া, পচাকোড়ালিয়া ও ধানসাগর এলাকায় পাঁচবার, ২০০৭ সালে পচাকোড়ালিয়া, নাংলি ও ডুমুরিয়ায় তিনবার, ২০১০ সালে গুলিশাখালীতে একবার, ২০১১ সালে নাংলীতে দুইবার, ২০১৪ সালে গুলিশাখালীতে একবার, ২০১৬ সালে নাংলী, পচাকোড়ালিয়া ও তুলাতলায় তিনবার, ২০১৭ সালে মাদ্রাসারছিলায় একবার এবং ২০২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ধানসাগর এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
২০২১ সালের ৩ মে পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের দাসের ভারানি এলাকায় আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিস, বন বিভাগ ও স্থানীয়দের প্রায় ৩০ ঘণ্টার প্রচেষ্টায় পরদিন ৪ মে বিকেল ৫টায় আগুন নিভে যায়। পরে ৫ মে সকালে আগের অগ্নিকাণ্ডের দক্ষিণ পাশে আবারও আগুন লাগে।
এবার শনিবার (২২ মার্চ) সুন্দরবনের কলমতেজী টহল ফাঁড়ি এলাকায় আগুন লেগেছে। সুন্দরবনের সবকটি আগুনের ঘটনাই শুষ্ক মৌসুমে।
তদন্ত হলেও সমাধান নেই
প্রতিবার আগুন লাগার কারণ, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও পরবর্তী সময়ে এ ধরনের ঘটনা এড়াতে তদন্ত কমিটি গঠন করে বন বিভাগ। তদন্ত কমিটি নির্দিষ্ট সময়ে সুপারিশসহ রিপোর্টও পেশ করে। তবে সেসব থেকে যায় ফাইলবন্দি।
সেই সুপারিশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—৪০ কিলোমিটার খাল ও তিনটি পুকুর পুনঃখনন, আগুন লাগলে তা নিয়ন্ত্রণে বন বিভাগের জনবল বাড়ানো, বনরক্ষীদের টহল কার্যক্রম জোরদার, তিনটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার তৈরি, সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের ৩৫ কিলোমিটার এলাকায় নাইলনের দড়ি দিয়ে বেড়া নির্মাণ, রিভার ফায়ার স্টেশন নির্মাণ ও বনসংলগ্ন ভরাট হয়ে যাওয়া ভোলা নদী খনন করা।
সুন্দরবন বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০০২ সাল থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে এ নিয়ে অন্তত ২৬ বার আগুন লাগার ঘটনা ঘটলো।
বারবার আগুন লাগে কেন
সুন্দরবনে এসব অগ্নিকাণ্ডে তিলে তিলে নিঃশেষ হচ্ছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে আগলে রাখা এই বন। বার বার আগুনে পোড়ে সুন্দরবন। এর পেছনে নানা স্বার্থান্বেষী মহলের হাত থাকতে পারে বলে মনে করেন সুন্দরবনপ্রেমীরা। এক শ্রেণির অতিলোভী বনজীবীর লাগানো আগুনে পুড়ে ছাই হচ্ছে সংরক্ষিত এই ম্যানগ্রোভ বনের একরের পর একর গাছপালা।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদনের বেশিরভাগে জেলে ও মৌয়ালদের বিড়ি-সিগারেট বা মৌমাছি তাড়াতে জ্বালানো মশাল থেকে আগুনের সূত্রপাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এ নিয়ে দ্বিমত আছে বনজীবীদের।
অনেকের দাবি, কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং বন বিভাগের অসাধু এক শ্রেণির কর্মচারীদের সহায়তায় বনে আগুন ধরিয়ে দেয় অসাধু মাছ ব্যবসায়ীরা। পরে বর্ষা মৌসুমে এসব স্থান প্লাবিত হলে নেট বা জাল দিয়ে সহজেই অধিক মাছ শিকার করে তারা।
পরিবেশবাদীদের ভাষ্য
সুন্দরবনের আগুন ‘মানবসৃষ্ট ও পরিকল্পিত’ বলে পরিবেশবাদী সংগঠন ও সুন্দরবনপ্রেমীরা বারবার দাবি করেছেন। তারা এ বিষয়ে সরকারকে অধিক গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেন।
পরিবেশবাদী নাগরিক সংগঠন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) খুলনা জেলার সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট মো. বাবুল হাওলাদার বাংলানিউজকে বলেন, প্রতি বছর দাউ দাউ করে সুন্দরবন পুড়ে ছারখার হলেও টনক নড়ছে না বন বিভাগের। ঘটনার পর শুধু বন বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়ে তদন্ত কমিটি করা হয়। ফলে অগ্নিকাণ্ডের মূল রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব হয় না। যে কারণে সুন্দরবনে গত দুই যুগে আগুন লাগার সঠিক কারণ উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি। শাস্তি হয়নি অপরাধীদের। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে।
সুন্দরবন গবেষক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এ আজিজ বাংলানিউজকে বলেন, বারবার সুন্দরবনে আগুন লাগা উদ্বেগজনক। সুন্দরবনের ভূপ্রকৃতি এবং বর্তমান আবহাওয়া বিবেচনায় নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এটি প্রাকৃতিকভাবে ঘটেনি। এটি দুষ্কৃতকারীদের কাজ। ঘটনা তদন্ত সাপেক্ষে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।