দুর্নীতিতে ডুবে ছিল হাসিনা সরকারের হাতিয়ার মঈনের সময়ের ‘দুদক’ 

দুর্নীতিতে ডুবে ছিল হাসিনা সরকারের হাতিয়ার মঈনের সময়ের ‘দুদক’ 

গত আড়াই বছরে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এর সদ্যবিদায়ী মঈন উদ্দিন আবদুল্লাহ কমিশন ব্যস্ত ছিল ছোটখাটো দুর্নীতি ধরায়। শেখ হাসিনা সরকার না চাইলে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কোনো অনুসন্ধান বা মামলাও করেনি সংস্থাটি।সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটে বেসিক ব্যাংকের ভুয়া তদন্ত প্রতিবেদনে। হোতাদের বাদ দিয়ে মামলার চার্জশিট অনুমোদন দেয় দুদক। এর নেপথ্যে ছিলেন তৎকালীন দুদক চেয়ারম্যান মঈন উদ্দিন আবদুল্লাহ, দুই কমিশনার জহুরুল হক ও আছিয়া খাতুন।

দুদক সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া সূত্র আরও জানিয়েছেন, কমিশনার জহুরুল হকের বিরুদ্ধে পরিবারের সদস্যদের জন্য দুদক থেকে নিয়মবহির্ভূত সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ, নিজের ছেলের হাসপাতাল থেকে নেওয়া ভুয়া ভাউচারে দুদক থেকে বিল তোলা এবং ক্ষমতার জোরে রাজউকের প্লট বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে তাঁর পাসপোর্ট বাতিল এবং দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার পদক্ষেপ নিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনায় তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, বেসিক ব্যাংকের যেসব ঋণ নিয়ে কেলেঙ্কারি হয়েছে সেগুলোর অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ ছিল ব্যাংকটির বোর্ড। অথচ মামলায় বোর্ডের কাউকে আসামি করা হয়নি। উল্টো তাঁদের সুবিধা নেওয়ার জন্য মঈন উদ্দিন কমিশনের নির্দেশে সাক্ষী করা হয়। ওইসব ঋণ যেসব ব্যাংক হিসাবে গেছে সেসব ব্যাংক হিসাবের অ্যানালাইসিস কিংবা বিশ্লেষণ করা হয়নি। ভুয়া কাগজে ঋণ কোথায় হস্তান্তর কিংবা রূপান্তর হয়েছে তা চিহ্নিত করা হয়নি। এমনকি বেসিক ব্যাংকের মামলায় মানিলন্ডারিংয়ের বিষয়টি আনা হয়নি।

গত বছরের জুনে বেসিক ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের ৫৯ মামলায় ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুসহ ১৪৬ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট অনুমোদন দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মোট ১৪৭ আসামির মধ্যে ৪৬ জন ব্যাংক কর্মকর্তা ও ১০১ জন গ্রাহক। দুদক কর্মকর্তাদের অভিযোগ, দুদক কাগজে-কলমে স্বাধীন হলেও আগের কমিশন হাসিনা সরকারের সবুজ সংকেত ছাড়া দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কোনো অনুসন্ধান শুরু করেনি। সব সময় ক্ষমতাসীন সরকার দুদককে দলীয় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। ফলে সংস্থাটির ভেতরেও অনিয়ম-দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে। একাধিক পরিচালক ও মহাপরিচালক বলেন, ছোটখাটো দুর্নীতি ধরার ক্ষেত্রে দুদক ছিল স্বাধীন।

আর হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি তাঁরা। হাসিনা সরকারের ইশারায় মাঝেমধ্যে দু-এক জনের বিরুদ্ধে লোক-দেখানো তদন্ত করলেও পরে তা থেমে যায়। ফলে ভাবমূর্তির সংকটে পড়ে সংস্থাটি। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও দুবাইয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রীর বিপুল সম্পদ থাকার খবর আগে থেকেই গণমাধ্যমে প্রচার হয়ে আসছিল। খবরে বলা হয়, তাঁদের নামে বিদেশে বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে বড় অঙ্কের অর্থ জমা রয়েছে। বিদেশে অর্থ জমা রাখার ব্যাপারে তাঁরা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনো অনুমতি নেননি। গত ৪ মার্চ এসব প্রমাণ ও নথি টিআইইউকে ও টিআইবির উদ্যোগে বিএফআইইউ, দুদক, সিআইডি, এনবিআর ও অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে পাঠানো হয়।

কিন্তু সব তথ্যপ্রমাণ হাতে থাকা সত্ত্বেও হাসিনা সরকারের পতনের আগে মঈন উদ্দিন আবদুল্লাহ কমিশনকে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এরপর বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ব্যাংকগুলোকে সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তাঁর পরিবারের হিসাব জব্দ করার নির্দেশনা দেয়। এরপর দুদকও অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে এস আলম গ্রুপ ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংক দখল করার পরও দুদক চুপ ছিল। এরপর সরকার পতনের পর অনুসন্ধান শুরু করার ঘোষণা দেয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক এবং দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘দুদকের আগের কমিশন শেখ হাসিনা সরকারের হাতিয়ার এবং সুরক্ষাকারী হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকার পরও তারা সরকারের কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। যার ফলে তারা দুর্নীতি আরও বিকশিত করার সুযোগ করে দেয়। যে কারণে সরকারের যেসব প্রতিষ্ঠান সংস্কার করা প্রয়োজন হয় তার মধ্যে দুদকও অন্যতম। ’ দুদকের কর্মকর্তারা বলেন, দুদকের সব সিদ্ধান্ত নেন চেয়ারম্যান ও দুই কমিশনার।

এর বাইরে দুদকের কোনো কর্মকর্তা স্বাধীনভাবে অনুসন্ধান শুরু কিংবা মামলা করতে পারেন না। তদন্ত কর্মকর্তারা দূরের কথা, একজন মহাপরিচালকও কোনো দুর্নীতি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত দিতে পারেননি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি গাড়ি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের অভিযোগে আগে অনেকের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। সেই দুদকেরই কমিশনার জহুরুল হক তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের চলাফেরায় চালকসহ সরকারি গাড়ি ব্যবহার করতেন। সাড়ে তিন বছর আগে বেআইনিভাবে সংস্থাটি থেকে গাড়িটি বরাদ্দ নেন তিনি। রাজধানীর বাড্ডায় এএমজেড হাসপাতালটির মালিক তাঁর ছেলে। চিকিৎসার নামে সেই হাসপাতাল থেকে ভুয়া ভাউচার নিতেন জহুরুল হক। এরপর সেটি দুদকে জমা দিয়ে প্রতি মাসে দেড় লাখ টাকা করে বিল তুলে নিতেন। এসব বিষয়ে জানতে তাঁর মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় এবং মেসেজ পাঠানো হয়।

কিন্তু তিনি কোনো সাড়া দেননি। দুদকের সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছেন, জহুরুল হকের নিজের ব্যবহারের জন্য একটি গাড়ি বরাদ্দ ছিল। এর বাইরে ২০২১ সালের এপ্রিলে তিনি চালকসহ আরেকটি গাড়ি সার্বক্ষণিক ব্যবহার করার জন্য বরাদ্দ নেন। সেই গাড়িতে তাঁর স্ত্রী ও ছেলে অফিসে যাতায়াত করতেন। বরাদ্দ নেওয়া গাড়িটির চালক ছিলেন সাদ্দাম হোসেন। পদত্যাগের পর আরও এক মাস তিনি গাড়িটি ব্যবহার করেন।

দুদক জানায়, রাষ্ট্রায়ত্ত পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)-এর গাড়ি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করে সরকারের আর্থিক ক্ষতি করার অভিযোগে কোম্পানিটির দুই কর্মীর বিরুদ্ধে গত বছর মামলা করে দুদক। অথচ দুদকের শীর্ষস্থানীয় এক কর্মকর্তা একই অপরাধ করেছেন। এদিকে সরকারি চাকরিজীবী কোটায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)-এর পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ৫ কাঠা আয়তনের দুটি প্লট বরাদ্দ নেন দুদকের সদ্যবিদায়ী কমিশনার জহুরুল হক ও তাঁর স্ত্রী মাসুমা বেগম। প্লট বরাদ্দ বিধিমালা অনুযায়ী কোনো পরিবারকে একাধিক প্লট বরাদ্দ দেওয়া হলেও একটি রেখে অন্যটি রাজউকের কাছে সমর্পণ করতে হয়। কিন্তু দুদক কমিশনার ও তাঁর স্ত্রীর ক্ষেত্রে সেটি হয়নি। দুদক কমিশনার উল্টো তাঁদের দুটি প্লটের আয়তনের সমান একটি ১০ কাঠার প্লট নিয়েছেন।

জানা যায়, রাজউক কর্মকর্তারা উপায়ান্তর না পেয়ে দুটি প্লটের আয়তনের সমান একটি প্লট তাঁকে দিয়েছেন। ২০২১ সালের ৩ মার্চ বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)-এর সাবেক চেয়ারম্যান মো. জহুরুল হককে কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি একই বছরের ১০ মার্চ দুদকে যোগ দেন। তাঁর ২০২৫ সালের ৯ মার্চ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল। কিন্তু ২৯ অক্টোবর তিনিসহ পুরো কমিশন পদত্যাগ করেন। এর আগে তিনি ২০১৪ সালের ৪ ডিসেম্বর ঢাকা মহানগর জেলা ও দায়রা জজ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023 EU BANGLA NEWS