‘গুম হওয়ার ট্রমা সহ্য করা যে কত কঠিন, তা আমি বুঝেছি। আমিও গুম হয়েছিলাম।গুম থেকে ফিরে দুইবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছি। আমি ডাক্তারের কাছে যখন গিয়েছি, ডাক্তার আমাকে বলেন, তুমি ভুলে যাও, ভাবো, এই ঘটনা ঘটেনি। আমি তখন গুমের পেইনটা বুঝেছি। ’
এভাবেই গুম হওয়ার পরের মানসিক অবস্থার বর্ণনা দেন কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার।
বুধবার (১১ ডিসেম্বর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে আয়োজিত ‘গণহত্যা, গুম ও ভয়ের সংস্কৃতি-মানবিক মর্যাদা ও সুবিচারের দাবি’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে তিনি নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। সকল প্রাণের নিরাপত্তা (সপ্রাণ) নামের একটি সংগঠন অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে।
২০১৭ সালের ৩ জুলাই সকালে রাজধানীর শ্যামলীর বাসা থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হন ফরহাদ মজহার। দীর্ঘ ১৮ ঘণ্টা পর গভীর রাতে নাটকীয়ভাবে যশোরে বাস থেকে তাকে উদ্ধার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। অবশ্য ফরহাদ মজহারের বিরুদ্ধেই ‘অপহরণের নাটক’ সাজানোর অভিযোগ তোলে পুলিশ।
ফরহাদ মজহার বলেন, ‘আপনি যখন জানবেন, আপনাকে বা আপনার পরিবারের কাউকে গুলি করে মেরে ফেলা হবে, অথবা ভয়াবহ নির্যাতন করা হবে; তার অনুভূতিটা ভয়ঙ্কর। আপনার ভাইকে আপনার সামনে থেকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তা যে ট্রমা তৈরি করে- তা ভয়ঙ্কর। ’
তিনি বলেন, ‘যারা গুম হয়েছেন, তারা কি ফিরে আসবেন? তারা কোথায় আছেন? এটা থেকে যে ট্রমা তৈরি হয়, তা ভয়াবহ। এই ট্রমায় কেবল গুম হওয়া ব্যক্তি নয়, পরিবারের অন্য সদস্যদের মাঝেও ট্রমা তৈরি হয়। ’
অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে এই চিন্তক বলেন বলেন, ‘যারা গুম হয়েছেন, তারা কি বেঁচে আছেন? তাদের কেন নেওয়া হয়েছে? এর উত্তর অন্তর্বর্তী সরকারকে জানাতে হবে। যে প্রশ্নের সমাধান করা জরুরি, তা আমরা করছি না। রাষ্ট্র যখন দুর্বল হয়, তখন সে প্রতিপক্ষকে দমন করার পদ্ধতি হিসেবে এ ধরনের গুম-খুনের পথে হাঁটে। ’
মানবাধিকারকর্মী মো. নূর খান লিটন বলেন, ‘গুমের শিকার ব্যক্তিদের আয়নাঘরে এমন ভয়ংকর বন্দি হিসেবে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কাটাতে হয়েছে, যেখানে পাঁচ–ছয় ফুট একটা জায়গায় সাপের মতো প্যাঁচ দিয়ে একটা মানুষকে থাকতে হয়। গুমের শিকার অনেক ব্যক্তির পেট কেটে ফেলা হয়েছে, নাড়িভুঁড়ি বের করা হয়েছে, বস্তা দিয়ে বেঁধে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়া হয়েছে, রাতের অন্ধকারে ক্রসফায়ারে তাদের জীবন দিতে হয়েছে। ’
তিনি বলেন, ‘কোনো নারী গুমের শিকার হয়েছেন কি না, ৫ আগস্টের আগে আমরা জানতাম না। ২০১৫ সালে একজন নারী গুমের শিকার হন। সেই নারীর খোঁজ আমরা এখনো জানি না। ’
গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবার নিয়ে কাজ করা সংগঠন মায়ের ডাকের সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম তুলি, নৃবিজ্ঞান ও গুমবিষয়ক গবেষক ইয়াসমিন আরা, জুলাই আন্দোলনে শহীদ ফারহান ফাইয়াজের পরিবারের সদস্যরা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।