তরুণদের ভবিষ্যৎ কোথায়

তরুণদের ভবিষ্যৎ কোথায়

‘ইয়ুথ ম্যাটার্স’ সার্ভে নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে বাংলাদেশের শতকরা ৪২ জন তরুণ এখন বিদেশে পাড়ি দিতে চায়। সংখ্যাটি কম শোনাচ্ছে, নাকি বেশি? নির্ভর করছে কাদের ওপর জরিপটি চালানো হয়েছিল তার ওপর।হতে পারে শহর ও গ্রামের, দুই দিকের তরুণদেরই খোঁজ নেওয়া হয়েছিল। শুধু যদি শহরের তরুণদেরই জিজ্ঞেস করা হতো এবং তারা যদি হতো শিক্ষিত, তাহলে ৪২ নয় তার চেয়েও বেশিসংখ্যক তরুণই বলত তারা বিদেশে পাড়ি দিতে উন্মুখ।

কারণ কী? প্রধান কারণ হচ্ছে দেশে কাজ নেই। বেকারত্ব বাড়ছে। বেকারত্ব অবশ্য গ্রামেই অধিক, বিশেষজ্ঞরা বলেন শহরের তুলনায় দ্বিগুণ; কিন্তু গ্রামের মানুষের সেই সাহস ও সামর্থ্য কোথায় যে বিদেশে যাবে?

তবু যায়। জমিজমা বেচে, ঘরবাড়ি বন্ধক রেখেও যেতে চায়। কারণ বিদেশে উপার্জনের সুযোগ আছে, দেশে যা নেই। এখন অবশ্য দেখা যাচ্ছে যে বিদেশে যারা গেছে তাদের কেউ কেউ আবার ফেরতও চলে আসছে। কারণ বিদেশেও এখন কাজের অভাব ঘটেছে। তার বড় কারণ অর্থনৈতিক মন্দা, আরেক কারণ যন্ত্রের উন্নয়নে কায়িক শ্রমের চাহিদায় ঘাটতি।

তা ছাড়া প্রতারকরাও তৎপর রয়েছে, তারাও তাদের কাজ করে, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিয়ে যায়। যায় মেয়েরাও। মেয়েদের চাহিদা আছে মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে সৌদি আরবে। সেখানে গিয়ে অনেক মেয়ে ভীষণ বিপদের মধ্যে পড়ে; কেউ কেউ বিক্রি হয়ে যায়। জোর করে যৌন ব্যবসায়ে বাধ্য করা হচ্ছে এমন অভিযোগও শোনা গেছে।

দাসপ্রথা বিলীন হয়ে গেছে কে বলবে?
বাংলাদেশের তরুণরা একসময় যুদ্ধ করেছে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। অল্পদিন ধরে নয়, অনেক দিন ধরেই। ব্রিটিশ শাসনামলে, পাকিস্তানের কালে। দারুণ যুদ্ধ হয়েছে ১৯৭১ সালে। তরুণরা ভয় পায়নি। পালিয়ে বেড়ায়নি। দলে দলে যুদ্ধে গেছে। প্রাণপণে লড়েছে এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বাধ্য করেছে আত্মসমর্পণে। সেই তরুণরাই তো এখন দেখা যাচ্ছে দেশ ছাড়তে পারলে বাঁচে। ওই যে বললাম বেকারত্ব ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। কর্মের সংস্থান নেই। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো; তারা জানাচ্ছে কর্মসংস্থান কমেছে প্রায় চার লাখ। এবং পরিসংখ্যান ব্যুরোর খবরেই প্রকাশ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা বেকার এখন আট লাখ। সরকারি তথ্য সব সময় সঠিক হয় না, নানা ভুলভ্রান্তি থাকে, বেসরকারি এবং প্রকৃত তথ্য বলবে বেকারের সংখ্যা আরো অধিক, এমনটাই আমাদের ধারণা। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য জানাচ্ছে যে বাংলাদেশের এক কোটি ৫০ লাখ মানুষ এখন বিদেশে আছে।

দেশের ভেতরে কর্মের সংস্থান বৃদ্ধি পেল না কেন? পরিশ্রম করার মতো লোকের তো অভাব নেই। যে তরুণরা বিদেশে যেতে চায় তারা তো সবাই পরিশ্রম করবে বলেই যায়। এমনকি বিদেশে গিয়ে যারা পড়াশোনার জন্য যেতে সংকল্পবদ্ধ তারাও তো পরিশ্রম করতে হবে জেনেই যায়, এবং গিয়ে প্রচুর পরিশ্রম করে। না, অভাব শ্রমের নয়, অভাব পুঁজির। কিন্তু পুঁজি কেন গড়ে উঠছে না; আয় কেন পুঁজিতে পরিণত হচ্ছে না? না তরুণদের ভবিষ্যৎ কোথায়হওয়ার কারণ আয় বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ধনীরা টাকা বিদেশে নিয়ে গিয়ে কেউ কেউ ভোগবিলাস করে, কেউ কেনে বাড়িঘর, অন্যরা ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগ করে। সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশি ধনীদের বিপুল বিনিয়োগ গড়ে উঠেছে। আমাদের দেশে উৎপাদিত কিছু পণ্য বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। তা থেকে আয়ও হয়। কিন্তু রপ্তানি আয়ের ৯ মিলিয়ন ডলার দেশে আসেনি। আয় দেশে আসছে না, বিদেশেই থেকে যাচ্ছে। আর সাম্প্রতিক সময়েই দুবাইয়ে বাংলাদেশিরা নাকি যাকে বলে চুটিয়ে ব্যবসা করছে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধির হার ভারতীয়দেরও হার মানিয়েছে। দুবাইয়ের বণিক সমিতিতে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এখন এক হাজার ৪৪টি।

তা ব্যবসা করছেন ভালো কথা, কিন্তু ওই টাকা তারা পেলেন কোথায়? নিশ্চয়ই দুবাইয়ে উপার্জন করেননি। নিয়ে গেছেন বাংলাদেশ থেকেই। বৈধ পথে নেওয়ার উপায় নেই, নিষেধ রয়েছে। নিয়েছেন অবৈধ পথেই। বৈধ পথে অনেক ঝামেলা, পদে পদে সন্তুষ্টকরণের আবশ্যকতা; অবৈধ পথ সে তুলনায় মসৃণ, দুই-চারটি বিন্দুতে সন্তোষ উৎপাদন বাড়লেই চলে, সব দরজা খুলে যায়। পি কে হালদারের অর্থপাচারের খবরটা অবিশ্বাস্য ঠেকে; যেন ঐন্দ্রজালিক। কিন্তু সেটা ঘটেছে। পি কে হালদার একজন নয়, অসংখ্য। তা ছাড়া হালদার মহাশয়ের পেছনে ও সামনে নিশ্চয়ই বড় মাপের মানুষেরা ছিল। নইলে তিনি পালালেন কী করে? এবং ধরা পড়লেও তার পুরো গল্পটা কেন জানা যায়নি?

তরুণরা যেভাবে লড়েছিল পরবর্তীতে তাদের সেই ভাবটা এখন নেই কেন? আমরা জানি যে সেই লড়াইটা ছিল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। রাষ্ট্র মিত্র ছিল না, শত্রু ছিল; লড়াইটা তাই অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছিল। কিন্তু রাষ্ট্র কী এখন মিত্র হয়ে গেছে, তাই আন্দোলন আর দরকার নেই?

না, ব্যাপারটা মোটেই তেমন নয়। রাষ্ট্র তখন শত্রু ছিল, এখনো শত্রুই রয়ে গেছে; মানুষের সঙ্গে তার শত্রুতা মোটেই কমেনি; বরং বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এই শত্রুতা এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি সুচতুর ও সুদক্ষ। তদুপরি তার গায়ে আছে নির্দলীয় আচ্ছাদন। শত্রুতা এখন ভান করে এবং প্রচার করে যে তার কাজ জনগণের জন্য সুযোগ-সুবিধা ও সুখ বৃদ্ধি করা, দেশের উন্নতি ঘটানো এবং রাষ্ট্র করে দেয়। এই সংবাদ যে রাষ্ট্রের যারা কর্তা তাদের সঙ্গে জনগণের কোনো বিরোধ নেই, তারা একই দেশের, একই জাতির মানুষ; সবাই সবার একান্ত আপনজন। প্রচারমাধ্যমের শক্তি সব সময়ই অদম্য, প্রযুক্তির বিকাশ ও মালিকানার পুঁজিবাদী দখলদারিত্বে মিডিয়া এখন যতটা শক্তিশালী ততটা আগে কখনো ছিল না। অর্ধসত্যকে তো বটেই, জলজ্যান্ত মিথ্যাকেও সে সত্য বলে প্রতিপন্ন করার ক্ষমতা রাখে। এবং ওই কাজই সে করে চলেছে।

রাষ্ট্র তারুণ্যকে ভয় করে, সমাজও যে তারুণ্যকে পছন্দ করে তা নয়। তারুণ্যকে দমিত করার সব ব্যবস্থা রাষ্ট্র তার নিজের অভ্যাসবশতই করে থাকে, সমাজও তাতে যোগ দেয়। একটা ব্যাপার ছোট মনে হতে পারে কিন্তু মোটেই ছোট নয়; সেটা হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রসংসদের নির্বাচন না দেওয়া। সেখানে দুঃসহ একাধিপত্য চলে সরকারি দলের ছাত্রদের। গণতন্ত্রের প্রাথমিক শিক্ষাটা তরুণরা পেতে পারে শিক্ষায়তনিক ছাত্রসংসদ থেকেই। ছাত্রসংসদ আগে ছিল; এমনকি সামরিক শাসনের সময়ও ছাত্রসংসদ বিলুপ্ত করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু ১৯৯১ সালে, স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর থেকে ‘গণতান্ত্রিক’ সরকাররা যখন ক্ষমতায় আসা-যাওয়া শুরু করল ঠিক তখন থেকেই ছাত্রসংসদ লুপ্ত হয়ে গেল, চলল সরকারদলীয় ছাত্র নামধারীদের স্বৈরাচার। এই যে ‘অগ্রগতি’ এর তাৎপর্যটা কী? তাৎপর্য হলো এটাই যে এরই মধ্যে রাষ্ট্র আরো বেশি স্বৈরতান্ত্রিক হয়েছে, যাত্রা করেছে ফ্যাসিবাদের অভিমুখে, যার আপাত-চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটেছিল পতনপূর্বে শেখ হাসিনার জমিদারতন্ত্রে। তরুণরা গুণ্ডা-বদমাশ হোক, মাদকের পাল্লায় পড়ুক, তারুণ্য গোল্লায় যাক, কিশোর গ্যাং গঠিত হোক—কোনো কিছুতেই আপত্তি তো নেই-ই, বরং সাগ্রহ অনুমতি আছে। কারণ তরুণ যত তার তারুণ্য খোয়াবে শাসকদের গদি ততই পোক্ত হবে। সোজা হিসাব!

বৈষম্যবিরোধিতার আওয়াজটা কিন্তু মোটেই নতুন নয়। এটি বঞ্চিতদের অতিপুরাতন রণধ্বনি; কিন্তু তাকে বারবার তুলতে হয়। কারণ বৈষম্য দূর হয় না, হবেও না, যদি ব্যবস্থা না বদলায়। ব্যবস্থা না বদলালে বৈষম্য বাড়তেই থাকবে এবং বাড়ছেও। উনসত্তরের ব্যবস্থা-কাঁপানো ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানের পরে মওলানা ভাসানী তার সেই অসামান্য তরুণ কণ্ঠে আওয়াজটা নতুন করে তুলেছিলেন; বলেছিলেন, ‘কেউ খাবে আর কেউ খাবে না, তা হবে না, তা হবে না। ’ বিশ্ববরেণ্য এক কবিতার বুঝি প্রথম পঙক্তি। ওই উনসত্তরেই ভাসানীপন্থী তরুণ আসাদ যখন পিতৃতান্ত্রিক স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের লেলিয়ে দেওয়া পুলিশের গুলিতে শহীদ হন তখন তার সহযোদ্ধারা স্লোগান দিয়েছিলেন, ‘আসাদের মন্ত্র জনগণতন্ত্র’। একই আওয়াজ, ভিন্ন শব্দগুচ্ছে। আসাদের পূর্বসূরি বায়ান্নর শহীদ বরকতও ছিলেন একই রাজনৈতিক ধারার মানুষ। সে ধারাও বৈষম্যবিরোধিতারই, রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে।

তারুণ্যের জয় হয়েছে। তারুণ্য যে কতটা অদম্য ও সৃষ্টিশীল তার প্রমাণ পাওয়া গেছে তরুণদের এই আন্দোলনে, যখন তারা বিপদ ও নিষেধাজ্ঞার মধ্যে নতুন নতুন কর্মসূচি দিয়েছে এবং তরুণদের উদ্যমে এবং তরুণদের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ও সমর্থনে যেগুলো যখন সফল হয়েছে। রাস্তার পাশে দেয়ালে দেয়ালে যেসব লেখা ফুলের মতো ফুটে উঠেছে তাতে দেখি সেই তারুণ্যের প্রকাশ যাকে দমন করে রাখা হয়েছিল।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023 EU BANGLA NEWS