তছনছ প্রতিটি কক্ষ, মাহবুবুর মোল্লা কলেজ যেন ধ্বংসস্তূপ

তছনছ প্রতিটি কক্ষ, মাহবুবুর মোল্লা কলেজ যেন ধ্বংসস্তূপ

রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইলের ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে হামলা ও ভাঙচুর চালিয়ে তছনছ করে ফেলা হয়েছে প্রতিটি কক্ষ। ভাঙা হয়েছে প্রায় প্রতিটি দরজা-জানালা।ছেঁড়া-ফাটা বই, ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে থাকা চেয়ার-টেবিল আর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কাচের টুকরো দেখে মনে হবে, প্রতিষ্ঠানটি যেন ধ্বংসস্তূপ।  

পুলিশ বলছে, এই ঘটনায় স্বার্থান্বেষী মহল জড়িত। ছাত্রবেশে পরিকল্পিতভাবে হামলা চালানো হয়েছে। তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে। আর কলেজ কর্তৃপক্ষ বলছে, হামলা-ভাঙচুরের পাশাপাশি কলেজে লুটপাটও চালানো হয়েছে। এতে ৬০-৭০ কোটির মতো ক্ষতি হয়েছে।

সোমবার (২৫ নভেম্বর) দুপুর ১২টার দিকে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের সামনে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ শুরু হয়। এক পর্যায়ে মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা পিছু হটলে সোহরাওয়ার্দী ও নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীরা ওই কলেজের ভেতরে ও বাইরে ভাঙচুর চালান। পরে তারা ওই কলেজে লুটপাটও চালান।

সরেজমিনে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে গিয়ে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের হামলায় কলেজের ১২তলা দুটি ভবনের সামনের ও পেছনের প্রায় প্রতিটি জানালা ও দরজার গ্লাস ভেঙে গেছে। কলেজ প্রাঙ্গণের পুরোটি জুড়ে ভাঙা কাঁচের টুকরো পড়ে রয়েছে। কলেজের ভেতরের প্রতিটি শ্রেণিকক্ষ, অফিসকক্ষ, লাইব্রেরি, ক্যাশ কাউন্টার, অধ্যক্ষের কক্ষ, লিফট এমনকি টয়লেটও ভাঙচুর করা হয়েছে। তছনছ করে ফেলা হয়েছে কলেজের প্রবেশপথ ও ভেতরের থাকা ফুলের টবগুলোও।

কলেজের নিচতলায় নয়টি শ্রেণিকক্ষ রয়েছে। প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে রয়েছে টেবিল, চেয়ার, ব্ল্যাকবোর্ড। বাঁকা করে ফেলা হয়েছে ফ্যানের পাখা। ভাঙা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে সিসি ক্যামেরা। নিচতলায় একটি লাইব্রেরি রয়েছে। সেখানে ছেঁড়া-ফাটা অবস্থায় পড়ে রয়েছে বিভিন্ন বই। বুকশেলফগুলো এলোমেলোভাবে পড়ে রয়েছে। এছাড়া নিচতলায় থাকা কন্ট্রোল রুম, ক্যাশ কাউন্টার, ফ্রন্ট ডেস্ক ও অফিস রুমও ভেঙে তছনছ করা হয়েছে। সেসব রুমে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেছে।

কলেজের দ্বিতীয় তলায় বিভিন্ন অফিস রুম, স্টোর রুমের পাশাপাশি কলেজের অধ্যক্ষ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের রুম রয়েছে। সবগুলো রুমই ভাঙচুর করা হয়েছে। সেখানেও কাগজপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। প্রতিটি লিফটের বাটন ভাঙা হয়েছে। তবে নিচতলা ও দ্বিতীয় তলার কোনো রুমে কোনো কম্পিউটার বা দামি জিনিসপত্র দেখা যায়নি। সংঘর্ষের সময় সেগুলো লুটপাট করা হয়েছে।

এই দুটি তলার মতোই অবস্থা বাকি ১০টি তলার প্রতিটি কক্ষের। তবে কলেজের ল্যাব ভাঙচুরের ফলে ক্যামিক্যাল ছড়িয়ে পড়ায় এবং গ্যাস লাইন লিকেজ হওয়ায় সেগুলো ঘুরে দেখা যায়নি। এই প্রতিবেদক কলেজের দ্বিতীয় তলায় ওঠার পরই চোখে জ্বালা-পোড়া অনুভব করেন। পাশাপাশি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও সাধারণ মানুষকে এই বিষয়ে সতর্ক করতে শোনা যায়।

এই ঘটনায় ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। তারা বলছে, হামলায় একটি স্বার্থান্বেষী মহল জড়িত।

ছাত্রবেশে সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়েছে
বিকেল ৪টায় ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ পরিদর্শন শেষে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ওয়ারী বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. ছালেহ উদ্দিন বলেন, আমি এটিকে দুর্ঘটনা বলবো না। একটি অবৈধ সমাবেশের মাধ্যমে কয়েক হাজার ছাত্রবেশে সন্ত্রাসী, যারা এলাকার আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাতে চায়, তারা সংঘবদ্ধ হয়ে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে হামলা করেছে। আমরা সীমিত পুলিশ সদস্য প্রথমে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় তাদের আটকে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। তারা আমাদের প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে লাঠিসোঁটা নিয়ে, সঙ্গে লোকজন একত্রিত হয়ে মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে হামলা করেছে।

তিনি বলেন, আমরা সেনাবাহিনীর সদস্যদের নিয়ে কলেজের ভেতরে প্রবেশ করেছি। বিভিন্ন তলার বিভিন্ন কক্ষ পরিদর্শন করেছি। এখানে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে। কোটি কোটি টাকার সম্পদ লোপাট হয়েছে। যেটা খুবই ন্যক্কারজনক। একটি স্বার্থন্বেষী মহল এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে আমরা মনে করি।

মো. ছালেহ উদ্দিন বলেন, আমরা এই ধরনের কোনো ঘটনা আর বরদাশত করবো না। যারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তাদের আমরা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আইনের আওতায় নিয়ে আসবো। এই ঘটনায় মামলা হবে এবং পরবর্তী যে আইনানুগ প্রক্রিয়া আছে সেগুলোতে আপনারা (এলাকাবাসী) সহযোগিতা করবেন।

৬০-৭০ কোটি টাকার মতো ক্ষতি: অধ্যক্ষ
ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের অধ্যক্ষ ওবায়দুল্লাহ নয়ন বলেন, শিক্ষার্থীদের হামলায় আমাদের ১২ তলা ভবনের কোনো কাঁচ আর অক্ষত নেই। পাঁচটি লিফট, কম্পিউটার ও সায়েন্স ল্যাব ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। হামলাকারী শিক্ষার্থীরা নগদ টাকা, শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট, সার্টিফিকেট, ৩০০ এর ওপরে ফ্যান, প্রায় ৩০টির মতো ল্যাপটপ, অসংখ্য কম্পিউটারসহ মূল্যবান ও প্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিস লুট করেছে। এতে প্রায় ৬০-৭০ কোটির মতো ক্ষতি হয়েছে।

নজরুল কলেজের সামনে জড়ো হয়ে মোল্লা কলেজের দিকে যাত্রা
সকাল ১০টার দিকে লাঠিসোঁটা হাতে সোহরাওয়ার্দী কলেজের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণে জড়ো হয়। পরে তারা মিছিল নিয়ে কবি নজরুল কলেজের সামনে আসেন। এ সময় নজরুল কলেজের অধ্যক্ষ মাইকে শান্ত হওয়ার আহ্বান জানালে দুই কলেজের শিক্ষার্থীরা ‘ভুয়া, ভুয়া’ স্লোগান দিতে থাকেন।  

পরে দুপুর ১২টার দিকে তারা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ডেমরা সড়ক সংলগ্ন ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে হামলা চালান। তখন ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের সামনে থাকা ওই কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আক্রমণকারী দুই কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে মুহূর্তেই যাত্রাবাড়ী-ডেমরা সড়ক রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন।

আহত ৩৫ জন ঢামেকে
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩৫ জন শিক্ষার্থী সেখানে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের বেশিরভাগই সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও নজরুল কলেজের শিক্ষার্থী।

৬ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন
পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেখানে ছয় প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়। এছাড়া পুলিশ, সেনাবাহিনী, র‌্যাব ও এপিবিএনেরও বিপুল সংখ্যক সদস্য সেখানে মোতায়েন করা হয়।

যেখান থেকে ঘটনার সূত্রপাত
মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থী অভিজিৎ হালদার অসুস্থ হয়ে গত ১৬ নভেম্বর সকালে পুরান ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউট হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে ভর্তি হন। গত ১৮ নভেম্বর হাসপাতালে মৃত্যুরবণ করেন। তিনি ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত ছিলেন। কিন্তু ভুল চিকিৎসায় অভিজিতের মৃত্যু হয়েছে অভিযোগ তুলে গত রোববার (২৪ নভেম্বর) ওই হাসপাতাল ঘেরাও কর্মসূচি দেন মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা। পূর্বঘোষিত সেই ‘সুপার সানডে’ কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউট হাসপাতাল ও পাশের সোহরাওয়ার্দী কলেজে ব্যাপক ভাঙচুর চালান মোল্লা কলেজসহ কয়েকটি কলেজের শিক্ষার্থীরা।

ওই সময় সোহরাওয়ার্দী কলেজে চলতে থাকা অনার্স প্রথম বর্ষের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। ওই হামলা ও ভাঙচুরের ‘জবাব’ দিতে রাত থেকেই অনলাইনে-অফলাইনে সংঘবদ্ধ হতে থাকেন সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীরা।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023 EU BANGLA NEWS