একাধিক টি-টোয়েন্টি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ আইসিসির দুর্নীতি বিরোধী নীতি মেনে চলছে না। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফকে এমনটাই জানিয়েছেন আইসিসির এক সাবেক কর্মকর্তা।এর মধ্যে বাংলাদেশের একমাত্র টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট বিপিএলও রয়েছে।
টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত দুই আসরে বিপিএলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ৩০টিরও বেশি অভিযোগ এসেছে। কিন্তু সেই অভিযোগ আমলে নিয়ে কাউকে নিষিদ্ধ করা হয়নি।
২০২৩ সাল পর্যন্ত ৭ বছর আইসিসির অ্যান্টি-করাপশন ইউনিটের (আকসু) তদন্ত সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করেছেন স্টিভ রিচার্ডসন। তিনি জানান, লিগগুলোর সংগঠক ও নির্দিষ্ট কিছু ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিকদের দুর্নীতির বিষয়ে উদ্বিগ্ন আইসিসি। সাবেক এই কর্মকর্তা টেলিগ্রাফকে বলেন, ‘কয়েকটি লিগে কয়েকটি ফ্র্যাঞ্চাইজির সততার বিষয়ে আমি সবসময় সন্দিহান থাকব। ’
বিশ্বজুড়ে ছোট সংস্করণের লিগগুলোতে দুর্নীতির আশঙ্কা নিয়ে এই সপ্তাহেই একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে টেলিগ্রাফ। যেখানে উল্লেখ করা হয়, কয়েকটি দলের মালিক নিজেদের দলের হারের পক্ষেই বাজি ধরছেন এবং খেলোয়াড়দের দিয়ে ম্যাচ পাতাচ্ছেন।
বর্তমানে খেলাধুলার স্বচ্ছতা বিষয়ক পরামর্শক হিসেবে কাজ করা রিচার্ডসন আরও বলেন, ‘আইসিসির দুর্নীতি বিরোধী নীতির প্রতি অনেক লিগ কেবল মুখেই গুরুত্ব দিচ্ছে। টুর্নামেন্টগুলো খরচ কমানোর চেষ্টা করা করলে, খেলার জন্য যে ঝুঁকিগুলো তৈরি হতে পারে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকা দরকার। ’
‘যদি ক্রিকেট বোর্ডগুলো ন্যূনতম মানদণ্ডগুলো অনুসরণ করে তাহলে সুরক্ষিত থাকবে তারা। তবে ব্যক্তিকেও সেই ন্যূনতম মানদণ্ড মেনে চলতে হবে। যদি কেউ প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন না করে অথবা ঝুঁকির বিষয়গুলো উপেক্ষা করে, তাহলে তারা সমস্যায় পড়বে। ’
‘ছোট ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলো যখন নিজস্ব দুর্নীতি বিরোধি ব্যবস্থা রাখে, তখন ঝুঁকি থাকে; সেই ব্যবস্থা যথেষ্ট শক্তিশালী হবে তো? আইসিসির কোনো সহায়তা বা অভিজ্ঞতা এমনকি যোগাযোগ ছাড়া কোনো দুর্নীতি বিরোধী কর্মকর্তা লিগটিকে সেরা উপায়ে সুরক্ষিত রাখতে পারেন না। এমন উদাহরণ অনেক আছে। ’
রিচার্ডসন জানান, বোর্ডগুলো টুর্নামেন্টে দুর্নীতি বিরোধী পদক্ষেপে যথেষ্ট নজর না দিলে, এর পরিণতি গুরুতর হতে পারে।
তিনি বলেন, ‘বোর্ড প্রয়োজনীয় সতর্কতা না মেনে চলার ফলে কোনো দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি যদি একটি টুর্নামেন্ট বা দলের দায়িত্ব নেয়, তখন বলতে হবে খেলোয়াড়দের প্রতি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে তারা। ’
‘বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সবসময় দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা লিগে যুক্ত থাকার চেষ্টা করেন এবং এর মানে এই নয় যে, লিগগুলো দুর্নীতিগ্রস্তদের দ্বারা আয়োজিত হচ্ছে। কয়েকজন আছেন যারা ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছেন, কিন্তু তারা হয়তো বুঝতে পারছেন কী ধরনের ঝুঁকির মধ্যে আছেন তারা। ’
অনেক লিগের খেলায় মাঠে কিংবা টিভি পর্দার সামনে দর্শক কম থাকে। মূলত তারা ভারতীয় দর্শকদের আগ্রহের ওপর নির্ভরশীল।
রিচার্ডসন বলেন, ‘এই লিগগুলো প্রতি আসরের শুরু থেকেই হাই-রিস্কে (উচ্চঝুঁকি) থাকে। ছোট লিগগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই দেখানো হয় কেবল ভারতীয় টিভি চ্যানেলে। কারণ সেখানেই জুয়ার ব্যবসা রমরমা। ’
ভারতে খেলাধুলায় জুয়া নিষিদ্ধ হলেও বাস্তবে বিশাল অঙ্কের অর্থ জুয়ার বাজারে বিনিয়োগ করা হয়ে থাকে, যা নজরদারিতে রাখা প্রায় অসম্ভব।
রিচার্ডসন বলেন, ‘যদি টাকা-পয়সা স্পনসরশিপ কিংবা টিভি সত্বের রাজস্ব থেকে না আসলে তাহলে অর্থ আয়ের জন্য জুয়াসহ অন্যান্য উপায় অবলম্বনের প্রলোভন থাকতে পারে। জুয়ার বাজার থাকলে খেলায় দুর্বলতার সুযোগ তৈরি হয়। ’
আইসিসির সহযোগী সদস্য দেশগুলোকে নতুন লিগ অনুমোদনের ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানান রিচার্ডসন। লিগগুলোর অনুমোদনের জন্য যে ফি দেওয়া হয়, সে ব্যাপারে যেন ভালোভাবে যাচাই করে স্বাগতিক দেশের বোর্ড।
তিনি বলেন, ‘বেশিরভাগ সহযোগী সদস্যের দেশগুলো ফান্ডের অভাবে ভুগছে। তাই যখন কেউ ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট আয়োজনের অনুমতির জন্য তাদের ফি প্রস্তাব করে, তখন তা বেশ প্রলুব্ধকর। কিন্তু তারা সবসময় এনিয়ে প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাই করে না। তারা প্রশ্ন করে না যে, টাকা কোত্থেকে আসছে? তাদের(প্রস্তাবকারী) অতীত ইতিহাস কেমন? তারা সফলভাবে কোনো লিগ আয়োজন করেছে কি না? যদি কোনো একটিরও উত্তর সন্দেহজনক মনে হয়, তাহলে বুঝতে হবে এখানে বিপদের সম্ভাবনা আছে। ’
রিচার্ডসন অবশ্য নির্দিষ্ট কোনো লিগের নাম উল্লেখ করেননি। তবে বেশ কয়েকটি লিগ বিশেষ ঝুঁকিতে আছে বলে জানায় টেলিগ্রাফ। ২০২১ সালে আবুধাবি টি-টেন লিগে দুর্নীতির কার্যকলাপ স্বীকার করার পর পুনে ডেভিলসের সহ-মালিককে চলতি বছর নিষিদ্ধ করা হয়েছে। গ্লোবাল টি-টোয়েন্টি কানাডা ও বিভিন্ন লিজেন্ডস লিগসহ আরও অনেক লিগ নিয়েই অভিযোগ রয়েছে। দুর্নীতি প্রতিরোধে আইসিসি থেকে কোনো সহায়তা নেয়নি বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল)। শেষ দু বছরে তাই ৩০টির বেশি অভিযোগ খুঁজে পেয়েছে টেলিগ্রাফ।
রিচার্ডসন বলেন, ‘যদি কোনো মালিক বা টিম ম্যানেজমেন্টের কেউ দুর্নীতিগ্রস্ত হয়, তাহলে তারা সম্ভবত পছন্দের সিনিয়র খেলোয়াড় ও কোচিং স্টাফ দলে রাখবেন। যারা তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করবেন। এর মাধ্যমে কেবল স্পট ফিক্সিং হতে পারে। অন্য খেলোয়াড়দেরও স্পট ফিক্সিংয়ে লিপ্ত হতে প্ররোচিত করে। ’
‘দুই বা তিনটি ওভারে আসলে ফিক্সিং হতে পারে, পুরো ম্যাচের ফল নয়। এরপর তারা জুয়ার জন্য কিছু মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করা, যারা সেই ওভারগুলো বাজি ধরবে। এভাবেই একটি ফ্র্যাঞ্চাইজির মধ্যে দুর্নীতি সংঘটিত হতে পারে। ’
‘এসব টুর্নামেন্টে দুর্বল খেলোয়াড়দেরই বলির পাঠা বানানোন হয়। যদি কোনো খেলোয়াড় জীবনে কঠিন সময়ের মধ্যে থাকে, যেমন ব্যক্তিগত বা আর্থিক সমস্যায় ভুগছে, তখন তারা এটিকে সমস্যা নিরসনের পথ হিসেবে বেছে নেয়। কিন্তু আসলে এটি তাদের জন্য আরও সমস্যা নিয়ে আসে। তাই খেলোয়াড়দের সুরক্ষিত রাখতে হবে এবং এর জন্য শক্তিশালী ও কার্যকর স্বাধীন দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা থাকতে হবে। ’
টুর্নামেন্ট শুরু হওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে বেশ কয়েকটি ফ্র্যাঞ্চাইজির পুরোনো মালিকরা যখন সরে দাঁড়ান, তখন নতুন মালিকের আবির্ভাব ঘটে। বিষয়টিকে খেলাধুলার জন্য ‘হাই রিস্ক’ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
রিচার্ডসন বলেন, ‘এমনটা হওয়া উচিত নয়। মালিকদের নিয়ে ভালোভাবে যাচাই-বাচাই করা উচিত। হতে পারে টুর্নামেন্ট শুরুর আগে কোনো মালিক অর্থ প্রদান করতে পারলে, তার পরিবর্তে বিকল্প কাউকে সুযোগ দেওয়া হবে। সেটা ঠিক আছে, কিন্তু বিকল্প সেই মালিককে নিয়ে আগেই যাচাই-বাছাই করা উচিত। যাকে-তাকে সুযোগ দেওয়া ঠিক হবে না। ’
‘যেটা এই মুহূর্তে হচ্ছে না। শেষ মুহূর্তে এসে কেউ যদি মালিক হয়ে যান তাহলে তাকে ঠিকমতো যাচাই করার সুযোগ থাকে না। খেলাধুলাকে সুরক্ষিত রাখার জন্য বোর্ডগুলোও সবসময় শক্তিশালীভাবে যাচাইয়ের জন্য প্রস্তুত থাকে না। ’
রিচার্ড মনে করেন, লিগ শুরুর আগে খেলোয়াড়দের ফি এসক্রো অ্যাকাউন্টে রাখা উচিত, যাতে করে তাদের পারিশ্রমিকের নিশ্চয়তা দিতে আয়োজক কর্তৃপক্ষ। তার মতে, একই সময়ে অনুষ্ঠিতব্য দুটি ভিন্ন লিগের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ খেলোয়াড়দের বিশ্বব্যাপী নিষিদ্ধ করা।
তিনি বলেন, ‘এটি বিভিন্ন ধরনের দুর্বলতা তৈরি করে। ফ্র্যাঞ্চাইজির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর খেলোয়াড়দের যদি ফ্র্যাঞ্চাইজির প্রতি আনুগত্য না থাকে, তাহলে সেটা টুর্নামেন্ট ও খেলোয়াড়দের দুর্নীতির ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। ’
একটি লিগ থেকে বাদ পড়ার পর একই সময়ে নতুন কোনো লিগে অংশ নেওয়ার জন্য ইংলিশ ক্রিকেটারদের অনাপত্তিপত্র (এনওসি) না দেওয়ার পরিকল্পনা করছে ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড। এমনটাই জানিয়েছেন বোর্ডের প্রধান নির্বাহী রিচার্ড গুল্ড। রিচার্ডসন চান, অন্যান্য বোর্ডও এমন পদক্ষেপ নিক।