প্রতিনিয়ত খুলনায় মৎস্য চাষে প্রসার ঘটছে। এ জেলার প্রত্যন্ত এলাকার বিস্তীর্ণ জলরাশি মাছে পরিপূর্ণ।ব্যক্তিপর্যায়ে বিভিন্ন স্থানে চলছে মাছের আবাদ। এটি শুরু হয়েছে এক দশক আগে থেকে। মাছ উৎপাদনে উদ্বৃত্ত জেলা হিসেবে খুলনা থেকে গত অর্থবছরে (২০২৩-২৪) দুই হাজার ১৪৬ কোটি টাকার মাছ ও মাছজাত দ্রব্য বিদেশে রপ্তানি হয়েছে।
গ্রামীণ মৎস্য চাষে ইতোমধ্যে বিপ্লব ঘটে গেছে। আগে গ্রামে পুকুর বা দীঘিগুলোতে প্রাকৃতিকভাবে মাছের উৎপাদন হত। বর্তমানে সেখানে বৈজ্ঞানিক উপায়ে মাছের চাষ করায় মাছের উৎপাদন অনেক বেড়ে গেছে।
গ্রামের তরুণ যুবকরা বাণিজ্যিকভিত্তিতে মৎস্য খামার গড়ে তুলে আর্থিকভাবে সচ্ছল হচ্ছেন। এই জেলার সাদা সোনা খ্যাত চিংড়ির রয়েছে বিশ্ব বাজারে ব্যাপক চাহিদা।
বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান অথবা আত্মকর্মী হিসেবে উদ্যোক্তা তৈরিতে মাছ চাষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সফল চাষিদের সার্বিক পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি মাছ চাষে আগ্রহী করতে যুবকদের উদ্বুদ্ধ করছেন মৎস্য কর্মকর্তারা।
মৎস্য অধিদপ্তরের খুলনা জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, খুলনা জেলার নয় উপজেলায় ২৬ লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে মোট মাছের উৎপাদন এক লাখ ২৫ হাজার মেট্রিক টন। মাথাপিছু দৈনিক মাছ গ্রহণের চাহিদা মাথাপিছু ৫০ গ্রাম। মোট মাছের চাহিদা ৫৭ হাজার মেট্রিক টন। সেক্ষেত্রে খুলনায় মাছ উদ্বৃত্ত থেকে যায় ৬৮ মেট্রিক টনের অধিক।
৬ বছর ধরে বাড়ছে পোনার উৎপাদন
কার্প রেনু (কেজি) ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭১২০ কেজি, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৭১৫৫ কেজি, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬৮৩৯ কেজি, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭১৩০ কেজি, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৭৫৪৫ কেজি, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭৫৮৯ কেজি। তেলাপিয়া পোনা (কেজি) ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫৯০০ কেজি, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৯৩৮৩ কেজি, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১০৮৩৫ কেজি, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১২৫৯২ কেজি,২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৮৯৪২ কেজি, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১৯৭৮৫ কেজি।
বাগদা পিএল ( কোটি) ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২২১.৫ কোটি, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২২১.৪৭ কোটি, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২০১.০৮ কোটি, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৪৮.৫ কোটি,২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৫৪.০২ কোটি, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৯৬.৯০ কোটি। বাগদা পিএল স্পেসিক প্যাথজেন স্টিফ (এসপিএফ) (কোটি) ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ০ কোটি, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২ কোটি, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪.৬২ কোটি, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৫.১৫ কোটি, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৭০.৪৫ কোটি, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮৫.২৫ কোটি, গলদা পিএল পোস্ট লাভা (পিএল) ( কোটি) ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২.০০ কোটি, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২.৭৫ কোটি, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২.৮৯ কোটি, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩.২৫ কোটি, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫.৫০ কোটি, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭.৫৫ কোটি।
৬ বছরে মাছের উৎপাদন
২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১ লাখ ২ হাজার ৮৯৯ মেট্রিক টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১ লাখ ১০ হাজার ৩৩৫ মেট্রিক টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ লাখ ১১ হাজার ১০১ মেট্রিক টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ লাখ ১৬ হাজার ৯৪৬ মেট্রিক টন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১ লাখ ২২ হাজার ৩৫৭ মেট্রিক টন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১ লাখ ২৫ হাজার ৫১৯ টন।
খুলনার সফল মৎস্যচাষি বটিয়াঘাটা উপজেলার খলিসাবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা পঞ্চানন গাইন বাংলানিউজকে বলেন, আমার জমি আছে ১৪ বিঘা। সাতটা পুকুরের বাগদা চাষ করি। তিনটা পুকুরে মনোসেক্স আর টেংরা চাষ করি। একটা পুকুরে পাতারি আর ভ্যারাইটিজ মাছ চাষ করছি। আমি মাছ চাষ করে খুবই লাভবান হয়েছি। আমার দেখা দেখি অনেকেই উৎসাহিত হয়ে মাছ চাষ করছেন। আমার গ্রামে কেউ মাছের ঘেরে ক্যামেরা লাগিয়ে মাছ চাষ করেনি। আমি একটি ক্যামেরা লাগিয়েছি যাতে করে বিদেশিরা সরাসরি দেখতে পারে বাংলাদেশে কেমন পরিবেশে মাছ চাষ হয়। এবার ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছি। আশা আছে, এখান থেকে এক কোটি টাকার মাছ বিক্রি করতে পারবো।
রূপসার জাবুসা এলাকার মৎস্য চাষি শাওন বাংলানিউজকে বলেন, জাবুসা বিলে কয়েকজনে মিলে চিংড়ি চাষ করেছি। প্রতি সপ্তাহে ২০ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করতে পারি।
পাইগাছার ক্ষুদ্র চিংড়ি চাষি ঘোষাল গ্রামের জামিলুর রহমান রানা বলেন, আমি ঘেরের জমিতে ধান ও চিংড়িসহ অন্যান্য মাছ একসঙ্গে চাষ করে থাকি। ধানের উৎপাদন একটু কম হলেও মাছের উৎপাদন ভালো হয়। চিংড়ি ঘেরের আয় থেকে আমি জীবিকা নির্বাহ করে ভালো আছি।
মাছের পোনা ব্যবসায়ী ইলিয়াস হোসেন জানান, উপজেলায় পাঁচটি হ্যাচারি, ৫০টি নার্সিং পয়েন্ট ও শতাধিক পোনা বিক্রয়ের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এখানে হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
উপজেলা চিংড়ি চাষি সমিতির সভাপতি মোস্তফা কামাল জাহাঙ্গীর বলেন, এখানকার উৎপাদিত চিংড়ি ও অন্যান্য মৎস্য সম্পদ স্থানীয় ও জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়বেদ পাল বাংলানিউজকে বলেন, খুলনায় প্রতিবছরই বাড়ছে মাছ চাষ। দেশে এখন মৎস্য উৎপাদনে শীর্ষ জেলার মধ্যে খুলনা একটি। টানা ছয় বছর ধরে খুলনায় বাড়ছে পোনার উৎপাদন। গত অর্থবছরে (২০২৩-২৪) দুই হাজার ১৪৬ কোটি টাকার মাছ ও মাছজাত দ্রব্য বিদেশে রপ্তানি হয়েছে। খুলনায় ইলিশ আহরণের পাশাপাশি বাগদা ও গলদা চিংড়িসহ ব্যাপকভাবে তেলাপিয়া, কাঁকড়া ও কুচিয়ারও চাষ হয়। খুলনায় ২৬ লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে মোট মাছের উৎপাদন এক লাখ ২৫ হাজার টন। মাথাপিছু দৈনিক মাছ গ্রহণের চাহিদা মাথাপিছু ৫০ গ্রাম। মোট মাছের চাহিদা ৫৭ হাজার মেট্রিক টন। সেক্ষেত্রে খুলনায় মাছ উদ্বৃত্ত থেকে যায় ৬৮ টনের অধিক। দেশের ছয়টি মাছ উদ্বৃত্ত থাকার জেলার তালিকায় খুলনার স্থান রয়েছে।