সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষের জেরে গত বুধবার থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। এর মধ্যেই গাজীপুরের স্প্যারো অ্যাপারেলস সাত ট্রাক তৈরি পোশাক চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্দেশে পাঠায়। গতকাল বৃহস্পতিবার আরও আট ট্রাক তৈরি পোশাক পাঠানোর কথা থাকলেও বিদ্যমান পরিস্থিতির কারণে সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করে কর্তৃপক্ষ।
বিষয়টি নিশ্চিত করে স্প্যারো গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘কারখানার পণ্য উৎপাদন স্বাভাবিক রয়েছে। তবে উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে রপ্তানি পণ্য বন্দরে পাঠানো যায়নি। আমরা বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। দ্রুত এই পরিস্থিতির সমাধান দরকার।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এরই মধ্যে দুটি ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান ই-মেইলে জানতে চেয়েছে, তাদের পণ্য সময়মতো জাহাজীকরণ করা যাবে কি না। আমরা তাদের আশ্বস্ত করেছি, উৎপাদন স্বাভাবিক রয়েছে।’
কোটা সংস্কার আন্দোলন সহিংস রূপ ধারণ করায় শোভন ইসলামের মতো দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলছেন, যত দ্রুত সম্ভব আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা দরকার। আন্দোলন দীর্ঘায়িত হলে ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সময়মতো রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণ হবে না।
রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক, জুতা ও সিরামিকশিল্পের কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে কারখানার উৎপাদন সেভাবে ব্যাহত হচ্ছে না। তবে রপ্তানি পণ্য পরিবহনে কিছুটা প্রভাব পড়েছে। গতকাল ঢাকা ও আশপাশের কারখানা থেকে রপ্তানি পণ্যবাহী যানবাহন চট্টগ্রামের ডিপোগুলোতে যেতে পারেনি। উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে বিদেশি ক্রেতারাও উদ্বেগ জানাচ্ছেন। অন্যদিকে বিক্রি কমে যাওয়ায় দেশীয় বাজারনির্ভর কারখানাগুলো বিপাকে পড়েছে।
নারায়ণগঞ্জের এমবি নিট কারখানা গত বুধবার দুটি ট্রাকে করে তৈরি পোশাক চট্টগ্রামের বেসরকারি ডিপোর উদ্দেশে পাঠায়। গতকাল বিকেল পর্যন্ত সেগুলো পৌঁছায়নি। সেগুলো ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কোনো এক স্থানে আটকে আছে, এমন তথ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিদিনের জন্য ট্রাকভাড়া বাড়তি তিন হাজার টাকা করে গুনতে হবে। শেষ পর্যন্ত পণ্য ঠিকঠাক মতো পৌঁছাবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তো আছেই।
জানা যায়, রপ্তানিমুখী কারখানা থেকে প্রথমে কাভার্ড ভ্যানে রপ্তানি পণ্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন বেসরকারি ডিপোতে পাঠানো হয়। এরপর কাভার্ড ভ্যান থেকে পণ্য নামিয়ে ডিপোর ছাউনিতে রাখা হয়। এরপর ডিপো থেকে কনটেইনারে বোঝাই করে বন্দরে নিয়ে জাহাজে তুলে দেওয়া হয়। চট্টগ্রামে ১৯টি ডিপোতে সারা দেশের রপ্তানি পণ্যের ৮৯ শতাংশই এভাবেই সম্পন্ন হয়।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে বুধবার রাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে আটকা পড়ে শত শত যানবাহন। এরপর নিরাপত্তার শঙ্কায় কারখানাগুলো রপ্তানি পণ্য চট্টগ্রামে পাঠানো প্রায় বন্ধ করে দেয়।
কনটেইনার ডিপো সমিতির সভাপতি নুরূল কাইয়ূম খান বলেন, ১৯টি ডিপোর ভেতরে কনটেইনারে রপ্তানি পণ্য বোঝাইয়ের কাজ চলছে। তবে গতকাল ঢাকার কারখানাগুলো থেকে পণ্যবাহী যানবাহন আসেনি।
বন্দর কর্মকর্তারা বলেন, বন্দরে পণ্যবাহী গাড়ি আনা-নেওয়ার হার কমলেও সবকিছু স্বাভাবিক আছে। জাহাজ থেকে পণ্য ওঠানো-নামানো হচ্ছে। বৃহস্পতিবারও ১৩টি জাহাজ জেটিতে আনা-নেওয়া করা হয়েছে।
সাধারণত রপ্তানি পণ্য পরিবহন বাধাগ্রস্ত হলেও তাৎক্ষণিকভাবে প্রভাব পড়ে না। কারণ, সারা দেশের কারখানাগুলো থেকে চট্টগ্রামের ডিপোগুলোতে পণ্য আনার পর সব প্রক্রিয়া শেষ করতে এক-দুদিন সময় লাগে। এর পরই ডিপো থেকে গাড়িতে করে কনটেইনার বন্দরে নিয়ে জাহাজে তুলে দেওয়া হয়।
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের ফতুল্লা অ্যাপারেলসের স্বত্বাধিকারী ফজলে শামীম এহসান বলেন, আমার একজন বিদেশি ক্রেতা গতকাল তিনবার কল করেছেন। সময়মতো পণ্য পাবেন কি না, সেটি নিয়েই মূলত তাদের উদ্বেগ। যদিও কারখানার উৎপাদন স্বাভাবিক আছে।
ময়মনসিংহের ভালুকায় চামড়াবিহীন জুতার কারখানা রয়েছে ন্যাশনাল পলিমার গ্রুপের। শুনিভার্স ফুটওয়্যার নামের এই কারখানার উৎপাদন স্বাভাবিক থাকলেও গতকাল তিন ট্রাক রপ্তানি পণ্য চট্টগ্রাম পাঠাতে পারেনি।
ন্যাশনাল পলিমার গ্রুপের এমডি রিয়াদ মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, নিরাপত্তার কারণেই রপ্তানি পণ্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত স্থগিত করা হয়েছে। একইভাবে চট্টগ্রাম থেকে কাঁচামালবাহী ছয়-সাতটি ট্রাক কারখানার উদ্দেশে রওনা দেয়নি। পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি না হলে রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
আন্দোলনের কারণে কয়েক দিন ধরে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন বিপণিবিতানে ক্রেতাও কমে গেছে। গতকাল নিউমার্কেট, চাঁদনী চকসহ অধিকাংশ বিপণিবিতান বন্ধ ছিল। এতে তৈরি পোশাক, জুতা, সিরামিকসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রিতে ধস নেমেছে।
বাংলাদেশ সিরামিক উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিসিএমইএ) সভাপতি সিরাজুল ইসলাম মোল্লা বলেন, গ্যাস–সংকটের কারণে সিরামিক কারখানায় এমনিতেই উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে গিয়েছিল। যেটুকু উৎপাদন হচ্ছিল, সেটুকু বর্তমানে কমেছে। কারণ, বিক্রিতে ধস নেমেছে।
তবে কারখানার উৎপাদন ও রপ্তানিতে বড় কোনো প্রভাব পড়েনি বলে দাবি করেন তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি এস এম মান্নান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আমরা ব্যবসায়ীরা উদ্বিগ্ন। দ্রুত সমস্যার সমাধান হোক। এটাই আমাদের প্রত্যাশা।’