কলাপাড়া (কুয়াকাটা), পটুয়াখালী থেকে: কাদের গাজীর বয়স ৭০ বছর পেরিয়েছে। স্ত্রী আর দুই নাতিকে নিয়ে তার সংসার।টিনের ঘরে কোনোমতে যাচ্ছিল দিন। এর মধ্যে অভিশাপ হয়ে এলো ঘূর্ণিঝড় রিমাল। সর্বনাশা এ ঝড় তার ছোট্ট ঘরটা ভেঙে-চুরে নিয়েছে। তাদের করে গেছে নিঃস্ব।
ঘূর্ণিঝড়ের বিপদ কাটলে আশ্রয় কেন্দ্র থেকে কাদের গাজী যখন বাড়ি ফেরেন, নিজের ঘরের দিকে যেন তাকাতে পারছিলেন না। কষ্টে বুক ভেঙে আসছিল। টিনের চাল কোথায়, বেড়া কোথায়, আসবাবপত্র কোথায়, পোশাক-আশাক কোথায়, কোনো কিছুরই যেন হদিস পাচ্ছিলেন না। থমকে গিয়েছিলেন। ভাবতে পারছিলেন না কী করবেন।
অনেক সময় পরও চিন্তা করতে পারছিলেন না মেরামতটা শুরু করবেন কোথা থেকে! কষ্টটা বুকের ভেতর চেপে রেখে স্ত্রীকে সান্ত্বনা যোগান, থাকার ঘর আবার ঠিক হয়ে যাবে বলে আশ্বাস দেন নাতিদের। শুরু করেন ঘর গোছানোর কাজ
কাদের গাজীর কয়েক ঘর পরেই থাকেন মো. শাহ আলম। ঝড়ের আগের রাতেও তার ঘরে চাল ছিল ১২০ কেজি। ঝড়ের দুদিন পর যখন বাড়ি ফিরেছেন, তখন আর সে চাল তিনি পাননি। কাদা-পানিতে একাকার হয়ে সব চাল নষ্ট হয়েছে। তবু যতটা পেরেছেন, কাদা ধুয়ে ২-৩ কেজি বের করে তাই শুকিয়েছেন। এরপর সেই শুকনো চাল রেঁধে খাচ্ছেন। ভাতকে পান্তা বানিয়ে বাসি হলেও পুরো পরিবারসহ খাচ্ছেন আজ তিন ধরে। তিন দিনের সেই বাসি ভাত খেতে খেতেই নিজের ধ্বংসস্তূপের দিকে তাকিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করছিলেন, দুর্যোগে দুর্যোগে কেটে যাচ্ছে জীবন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘর গোছানোতে মনোযাগী হন।
এ গল্প শুধু কাদের গাজী বা শাহ আলমের নয়। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার টিয়াখালি ইউনিয়ন পরিষদের বঙ্গবন্ধু কলোনির প্রায় ৩০০ পরিবারেই এমন একটা করে মানবেতর জীবনযাপনের গল্প আছে। সেসব গল্প নিয়ে তারা প্রত্যেকে যেন এক একটা জীবন্ত ধ্বংসস্তূপ, যারা সবসময়ই চাপা পড়ে যান হিসাবের পরিসংখ্যানে।
শুক্রবার (৩১ মে) সরেজমিনে কলাপাড়ার বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা যায়, ১০০ কিলোমিটারের বেশি বাতাসের বেগ নিয়ে গত ২৬ মে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় রিমালের সঙ্গে জলোচ্ছ্বাস উপকূলীয় এলাকার অনেক ঘর ধসিয়ে গেছে। ঝড়ে গাছপালা ভেঙেও ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভেসে গেছে মাছের ঘের। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে পটুয়াখালীতে দফায় দফায় প্লাবিত হয়েছে চরাঞ্চলসহ শতাধিক গ্রাম।
কাদের গাজী বলছিলেন, ‘এমন করে ক্ষয়ক্ষতি এর আগে হয়নি। আমরা আসলে ভাবতেও পারিনি আমাদের ঘরবাড়ি এভাবে ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে যাবে। এর আগে সিডর গেছে, আইলা গেছে, তখনো আমরা দেখেছি যে- শুধু নিচ থেকে লবণ পানির কারণে কিছু মাটি সরে যায়। কিন্তু এভাবে এত বাতাস, এত ঝড়ে ঘর ভেঙে নষ্ট হয়ে যাওয়া, অনেকটাই অপ্রত্যাশিত ছিল আমাদের জন্য। ’
এ বৃদ্ধ বলেন, ‘আশপাশে যতটুকু ঘরের অংশ পেয়েছি তাই দিয়েই নিজের ঘরটা এখন ঠিক করার চেষ্টা করছি। অনেকেই আসছেন, খোঁজখবর নিচ্ছেন। কিন্তু সেভাবে কোনো সাহায্য আসছে না। সবাই আমাদের শুধু গোনার মধ্যেই রেখেছে। আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি আমাদেরই ঠিক করতে হবে। হারানো জিনিসপত্র আমাদেরই একটু একটু করে ফিরিয়ে আনতে হবে। ’
‘আগে অনেকে সহযোগিতা দিয়ে গেছে, এবার একেবারেই তা নেই’
একই কলোনির মোছা. রাশিদা খাতুন বলেন, ‘আজ ছয়দিন বিদ্যুৎ নেই। পানিতে চুলা ডুবে গেছে, রান্না করতে পারছি না। কোনো একজনের শুকনা চুলা থাকলে সেখানে ১০ পরিবারের রান্না করতে হচ্ছে। আবার রান্না যে করবো, সেই চাল-ডালও নেই। আগেরবার অনেকেই সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে গেছে, কিন্তু এবার একেবারেই যেন তা নেই। আজ কয়েকদিন আমরা সবাই শুধু চিড়া-মুড়ি খেয়েই দিন পার করছি। ’
তিনি বলেন, ‘আমাদের আসলে কপালটাই মন্দ। সেই জন্ম থেকে পানির সঙ্গে যুদ্ধ করছি, এখনো করতেই আছি। আগামীতেও করতে হবে। এই ঝড়ই তো আর জীবনের শেষ ঘূর্ণিঝড় না, সামনে হয়তো আরও আসবে। সবাই আমরা ঝড়ের ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সহানুভূতি জানাতে পারি, কিন্তু নিজেদের সেই জায়গাটিতে বসাতে পারি না। বসালে অবশ্যই কিছু হতো, সবাই শুধু মানুষ গুনে আর ছবি তুলে চলে যেতো না। ’
সার্বিক বিষয়ে পটুয়াখালীর ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা সুমন চন্দ্র দেবনাথ জানান, প্লাবিত হয়ে ও ঝোড়ো বাতাসে জেলায় মোট ২৩৫টি আধাপাকা ও কাঁচা ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তিন হাজার ৫০০ ঘরবাড়ি। এর মধ্যে কলাপাড়ার ক্ষয়ক্ষতিও অনেক। তাদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের বিষয়ে সরকার ও স্থানীয় প্রশাসন কাজ করছে।