নিয়োগ বিতর্কে মেয়াদের ৪ বছরই আলোচনায় ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) সদ্য সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার। চবির প্রথম এ নারী উপাচার্যের মেয়াদকালে প্রায় সাড়ে ৫০০ শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ পেয়েছেন।আর সেই নিয়োগ যাত্রায় কফিনের শেষ পেরেকটা ঠুকলেন দায়িত্বের শেষ দিনে ৩ ডজনেরও বেশি নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে।
গত ১৯ মার্চ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের।তিনি উপাচার্য পদে যোগ দান করেন পরদিন ২০ মার্চ সকালে। আর নতুন উপাচার্য নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার পর থেকে যোগদানের আগ পর্যন্ত অর্ধদিনেরও কম সময়ে বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই নিয়মবহির্ভূত প্রায় ৩৭ জনকে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ ওঠে অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারের বিরুদ্ধে।
এর মধ্যে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে- উচ্চমান সহকারী, নিম্নমান সহকারী, ঊর্ধ্বতন সহকারী, নিরাপত্তা প্রহরী, অফিস পিয়ন, বুক বাইন্ডার, কম্পিউটার ল্যাব সহকারী, ভোজনালয় সহকারী, পেশ ইমাম, ঝাড়ুদার এবং পরিচ্ছন্নতাকর্মী পদে ৬ মাসের জন্য এসব নিয়োগ দিয়ে যান তিনি।
২০২৩ সালের ৩ নভেম্বর অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারের উপাচার্য হিসেবে ৪ বছর মেয়াদ পূর্ণ হয়। তবে নানান কৌশলে সময় বাড়াতে চেষ্টা চালানোর পাশাপাশি গত তিন মাসে বিধিবহির্ভূতভাবে শতাধিক নিয়োগ দেন তিনি।
উপাচার্যের শেষ সময়ে নিয়োগ পাওয়া বেশিরভাগই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, এছাড়া স্থানীয়রাও পেয়েছেন প্রাধান্য। মোটা অংকের অর্থ দিয়ে নিয়োগ পাওয়ার নজিরও রয়েছে অধ্যাপক শিরীণ আখতারের সময়ে।
২০২২ সালের ৫ মার্চ চবির ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের বিতর্কিত নিয়োগ বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্ষদ সিন্ডিকেট। সেসময় শিক্ষক নিয়োগে লবিংয়ের ৫টি ফোনালাপ ফাঁস হয়। যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মচারীকে বলতে শোনা যায়- শিক্ষক পদে ১৬ লাখ, তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী পদে ১২ লাখ এবং চতুর্থ কর্মচারী পদে ৮ লাখ টাকা লাগবে নিয়োগ পেতে। এছাড়া চট্টগ্রামের হলে ১৬ লাখ এবং চট্টগ্রামের বাইরের হলে ২০ লাখ টাকা লাগে শিক্ষক হতে। এমন চাঞ্চল্যকর অডিও ফাঁস হওয়ার পরে ফার্সি বিভাগের নিয়োগটি বাতিল হলেও এরপরও থেমে ছিলো না নিয়োগ-বাণিজ্য।
২০২২ সালের ৬ আগস্ট আরও দুটি ফোনালাপ ফাঁস হয়, এতে দেখা যায় নিম্নমান সহকারী পদের কর্মচারী মানিক চন্দ্র দাস নিজেকে সেকশন অফিসার পরিচয় দিয়ে তিন চাকরি প্রার্থীর কাছ থেকে ৮ লাখ ২০ হাজার টাকা আদায় করেছেন। এসব ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল নিয়োগে স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্যাটিউট অনুযায়ী নিয়োগের জন্য অনুসরণ করতে হয় বেশকিছু নিয়ম। এর মধ্যে শূন্য পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, প্রার্থীদের আবেদন যাচাই, মৌখিক অথবা ব্যবহারিক পরীক্ষা, উত্তীর্ণ প্রার্থীদের নিয়োগের সুপারিশের পর বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট যাচাই-বাছাই শেষে নিয়োগের অনুমোদন দেয়। অথচ অধ্যাপক শিরীণ আখতার অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দায়িত্বের শেষদিন কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই দিয়েছেন কয়েক ডজন নিয়োগ।
যদিও ২০১৮ সাল থেকে দৈনিক মজুরি কিংবা অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ বন্ধ রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নির্দেশনা দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।
অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান ২০১৯ সালের ৪ নভেম্বর। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে, শিরীণ আখতারের সময়ে সিন্ডিকেটের অনুমোদনে ১৩০ জন শিক্ষক এবং ২৩৮ জন কর্মচারী নিয়োগে পেয়েছেন। অপরদিকে কোনোপ্রকার বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ১১৫ জন এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ৫৭ জন। সর্বমোট ৫৪০ জন শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে গেছেন অধ্যাপক শিরীণ আখতার।
এ বিষয়ে জানতে অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার কেএম নূর আহমদের সঙ্গেও একাধিকবার মুঠোফোনের যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
এদিকে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের নিয়োগের বিষয়ে বলেন, যোগ্যতার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ হবে। এখন থেকে যারা যোগ্য এবং মেধাবী তারাই নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ প্রাধান্য পাবে।