ইন্দোনেশিয়ায় প্রতি পাঁচ বছর পর পর সাধারণ নির্বাচনের সময় এলে রাজনীতিবিদরা আধ্যাত্মিক পরামর্শ এবং নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ জানতে তান্ত্রিকদের দরজায় কড়া নাড়েন। এমনই একজন তান্ত্রিক কি কুসুমো।ভোটের কয়েক মাস আগে থেকে আগের দিন পর্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটে তার।
দেশটিতে ‘ডুকুন’ নামে পরিচিত এ তান্ত্রিকদের ভূমিকা বেশ বিতর্কিত, তাদের নিয়ে আছে ভিন্ন ভিন্ন মতও। কিছু আদিবাসী এবং লৌকিক সম্প্রদায় বিশ্বাস করে যে, তান্ত্রিকরা নিরাময়, সুরক্ষা এবং আধ্যাত্মিক জগতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০ কোটিরও বেশি নাগরিক ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট এবং জাতীয় ও আঞ্চলিক আইনপ্রণেতা নির্বাচিত করতে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন।
অনেক ইন্দোনেশিয়ান তান্ত্রিকদের সন্দেহের চোখে দেখেন। বিশেষ করে তরুণরা। তেমনই একজন জাকার্তায় মার্কেটিংয়ে কাজ করা ৩২ বছর বয়সী ঘিনাস্তি রামাধান্তি। তার কাছে তান্ত্রিকদের কাজ ‘স্ক্যাম’ বলে মনে হয়।
ওয়েলকাম গ্লোবাল মনিটরের ২০২০ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, দেশটির ১৩ শতাংশ মানুষের লৌকিক উপায়ে নিরাময়ে বিশ্বাসী। আর ৪৩ শতাংশ মানুষের এ বিষয়ে ‘কিছুটা’ আস্থা আছে। তবে জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশেরও বেশি বলছে যে এদের ওপর তাদের আস্থা বা বিশ্বাস ‘খুব বেশি’ বা ‘একেবারেই’ নেই।
এ ছাড়া বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠী রয়েছে ইন্দোনেশিয়ায় এবং সাম্প্রতিক সময়ে দেশটিতে কট্টর ইসলামিক মতাদর্শ বাড়তে দেখা গেছে। ইসলাম ধর্মে আল্লাহ ব্যতীত অন্য সত্ত্বার কাছ থেকে সুরক্ষা এবং সহায়তা চাওয়া সাধারণত হারাম বলে বিবেচিত। আধা-সরকারি সংস্থা ইন্দোনেশিয়ান ওলামা কাউন্সিল (এমইউআই) প্রতিটি নির্বাচনেই রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের প্রার্থীদের সতর্ক করতে বলেন, যেন তারা তান্ত্রিকদের কাছ থেকে পরামর্শ না নেন।
এমইউআই ২০০৫ সালে তান্ত্রিকবিদ্যা হারাম বলে একটি ফতোয়া জারি করে। জিনের সঙ্গে যোগাযোগ থাকা মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে ভবিষ্যৎ জানা হারাম- যুক্তি দিয়ে এই ফতোয়া দেওয়া হয়। নির্বাচনী প্রচারণার শুরুতে এক্স হ্যান্ডলে এ সংক্রান্ত পোস্ট দেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান চোলিল নাফিস।
তবে কুসুমোর দাবি, তিনি যাদের সাহায্য করবেন, তারা অবশ্যই জিতবেন। অনুসারীদের জেতানোর জন্য তিনি জিনদের ব্যবহার করেন। তিনি তার অনুসারীদের তাবিজও দেন। যদিও জিনের মতো এ ধরনের তাবিজও ইসলামে নিষিদ্ধ।
কুসুমো বলেন, দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি কয়েক ডজন রাজনীতিবিদকে এবং ভোটের আগের দিন ‘ইন্দোনেশিয়াজুড়ে প্রার্থীদের’ পরামর্শ দিয়েছেন।
তবে তান্ত্রিকদের কাছে যাওয়া প্রার্থীরা ভোটারদের প্রতিক্রিয়ার ভয় পান। কুসুমো বলেন, বিশেষ করে লোকজন চেনে এমন পাবলিক ফিগার যারা আছেন এবং পুনরায় নির্বাচিত হতে চান, তারা রাত দুইটা-তিনটার দিকে আসেন। কারণ তারা চান না মানুষজন তাদের দেখুক। তারা মুখোশ পরাসহ বিভিন্ন ছদ্মবেশে আসেন।
তবে বিবিসির কাছে তিনি তেমন কারও নাম প্রকাশ করেননি। এই সাক্ষাতের অনেকগুলোই যেহেতু গোপন থাকে, তাই রাজনীতিবিদদের মধ্যে এ প্রবণতা কতটা বিস্তৃত তা জানা কঠিন।
ধর্ম ও দর্শনের থিংক ট্যাংক প্যারামাডিনা সেন্টারের পরিচালক মুসলিম স্কলার বুধি মুনাওয়ার রাচমানের মতে, ইন্দোনেশিয়ায় স্থানীয় বিশ্বাস প্রায়শই ধর্মের সঙ্গে মিশে যায়। যার ফলে জাদুবিদ্যার চর্চা আর ইসলামি বিশ্বাস সহাবস্থান করে।
এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ‘কেজাওয়েন’, এটি এমন একটি বিস্তৃত ব্যবস্থা যেখানে জাভানিজ অ্যানিমিজম, হিন্দু-বৌদ্ধ বিশ্বতত্ত্ব, রহস্যবাদ এবং ইসলামের উপাদানগুলো একসঙ্গে থাকে। ‘কেজাওয়েন’ শব্দটি নিজেই ইন্দোনেশিয়ার সবচেয়ে জনবহুল দ্বীপ জাওয়া বা জাভা থেকে এসেছে। দেশটির জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি এখানেই বাস করে।
দেশটির প্রায় সব রাষ্ট্রপতিই জাভা থেকে এসেছেন এবং মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও তারা কেজাওয়েনের কিছু আচার-অনুষ্ঠান পালন করেছেন- এমন ধারণা ব্যাপকভাবে প্রচলিত। বলা হয়, নিজের আত্মা শুদ্ধ করতে দেশটির প্রথম রাষ্ট্রপতি সুকর্ণ পবিত্র বলে গণ্য এক জঙ্গলে ধ্যান করেছিলেন এবং তার উত্তরাধিকারী সুহার্তো নিজ আত্মা শুদ্ধ করতে একটি নদীতে স্নান করেছিলেন।
নিজের জন্য শুভ মনে করায় বর্তমান প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো তার গুরুত্বপূর্ণ সরকারি সিদ্ধান্তগুলো জাভানিজ ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ঘোষণা করেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং একজন সম্মানিত ইসলামিক স্কলার আবদুর রহমান ওয়াহিদ বিশ্বাস নিয়ে তার বহুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং গভীর রাতে মুসলিম সাধুদের সমাধি পরিদর্শনের জন্য পরিচিত ছিলেন।
প্যারামাডিনা সেন্টারের পরিচালক রাচমান বলেন, কিছু রাজনীতিবিদ ইসলামিক উপায়ে তান্ত্রিক কাজ চালানো গুরুদের কাছে যাবেন।
পূর্ব জাভার বানিউওয়াঙ্গি শহরে স্থানীয় নির্বাচনে প্রচারণা চালানোর সময় একজন ইসলামিক গুরুর পরামর্শ নেওয়ার কথা স্বীকার করেন পার্টাই কেবাংকিতান বাংসা (পিকেবি) নামের একটি মধ্যপন্থী ইসলামী দলের সদস্য আহমদ রিফাই। তার গুরু তাকে একটি নির্দিষ্ট স্থানে প্রার্থনার বিষয়ে বিস্তারিত নির্দেশনা দিয়েছিলেন।
কিছু স্থানীয় বাসিন্দা আলাস পুরও নামের পবিত্র জঙ্গলে আত্মা থাকে বলে মনে করেন। আত্মায় বিশ্বাসীরা জঙ্গলটির লুকানো গুহায় ধ্যান করতে আসে। বলা হয়, সুকর্ণও সেখানেই গিয়েছিলেন।
বিব্রত হাসি দিয়ে রিফাই বলেন, আমি কোরআন পড়তে আলাস পুরওতে গিয়েছিলাম। আমি বিশ্বাস করি, এই মহাবিশ্বে কেবল মানুষই বসবাস করে না। আমি আল্লাহর সমস্ত সৃষ্টির সাহায্য চাই, সেটা দৃশ্যমান হোক কিংবা না হোক।
রিফাই অবশ্য নির্বাচনে আধ্যাত্মিক ও কৌশলগত হাতিয়ারের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছেন। পেশায় আইনজীবী রিফাই বলেন, তিনি কয়েক মাস ব্যক্তিগত ব্র্যান্ডিং, সামাজিক মাধ্যমে মিমস এবং নির্বাচনী জেলা ও ভোটারদের ম্যাপিংয়ের মতো বিষয়গুলো নিয়ে অনলাইন কোর্স করতে সময় ও অর্থ ব্যয় করেছেন।
ব্যাপক আন্দোলনের মুখে সুহার্তোর একনায়কতান্ত্রিক শাসনের অবসানের এক বছর পর ১৯৯৯ সালে ইন্দোনেশিয়ায় প্রথমবারের মতো গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। গণতন্ত্র আরও পোক্ত হওয়ায় প্রার্থীরা ভোটারদের সম্পৃক্ত করতে ব্যক্তিত্ব জাহিরের বিষয়টি মূল্যায়ন করছে।
বানিউওয়াঙ্গির নুসানতারা তান্ত্রিক অ্যাসোসিয়েশনের আরেক তান্ত্রিক আবদুল ফাতাহ স্বীকার করেছেন যে আচার-অনুষ্ঠান সত্ত্বেও তার অনেক রাজনীতিবিদ অনুসারী নির্বাচনে সাফল্য পাননি। তিনি বলেন, আমি মনে করি রাজনীতিবিদরা যদি ব্যর্থ হন, তাহলে তাদের পথ দেখাতে এবং শক্তি দেওয়ার জন্য এখনও আধ্যাত্মিক গুরুর প্রয়োজন হয়।
আহমদ রিফাই বলেন, প্রতিযোগিতামূলক স্থানীয় নির্বাচনের মধ্যে মনের প্রশান্তি বজায় রাখার জন্যই কেবল তিনি তার আধ্যাত্মিক গুরুর দিকে ঝুঁকেছেন। হারতে প্রস্তুত কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অবশ্যই। একজন সত্যিকারের যোদ্ধা হিসেবে, আমাদের জয় এবং হারের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আপনি যদি তেমন না হন, তবে রাজনীতির জগতে আসার ঝক্কি নিতে যাবেন না।
বিবিসি বাংলা অবলম্বনে