প্রেম করে বিয়ে করার পর মেয়ের পরিবার মেনে নেয়নি। বিবাহবিচ্ছেদ ঘটিয়ে মেয়েকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন তাঁরা। এ নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে ফাঁসানোর পরিকল্পনায় নিজের আপন ফুফুকে হত্যা করে ছেলে ও তাঁর স্বজনেরা। তবে তাঁদের পরিকল্পনা কাজে লাগেনি। উল্টো ফুফুকে হত্যার মামলায় এখন এক চাচাসহ কারাবন্দী তিনি।
ঘটনাটি ঘটেছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম থানার খায়েরপুর গ্রামে। এ ঘটনায় মিশলু ভূঁইয়া (২৭) ও তাঁর চাচা রশীদ ভূঁইয়াকে (৪৩) গ্রেপ্তার করেছে মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। প্রায় ৯ মাস মামলার তদন্ত করে গত বছরের ১৮ জুলাই মিশলুর ফুফু জিনারা খাতুনকে (৩০) কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় তাঁদের পরিবারের লোকজনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে বলে সিআইডি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি কিশোরগঞ্জের পরিদর্শক মো. জুলফিকার আলী চৌধুরী আজ বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, এই হত্যা মামলাটি প্রথমে অষ্টগ্রাম থানা-পুলিশ তদন্ত করে। ঘটনাটি নিয়ে তাদের সন্দেহ হয়। তবে তারা হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি। দুই মাস পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব সিআইডিকে দেওয়া হয়। তদন্তে নেমে তারা জানতে পারে, শ্বশুরবাড়ির লোক ও প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে মিশলুই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে জিনারা খাতুনকে খুন করেন।
মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট সিআইডি সূত্র জানায়, মিশলু তিন-চার বছর আগে মালয়েশিয়ায় থাকতেন। তখন নিজের গ্রামের মারিয়া আক্তারের সঙ্গে তাঁর প্রেম চলছিল। ২০২২ সালে মিশলু মালয়েশিয়া থেকে দেশে ফেরেন। এরপর মিশলু ও মারিয়া বিয়ে করেন। এ বিয়ে মারিয়ার পরিবার মেনে নেয়নি। মারিয়ার চাচা স্থানীয় মেম্বার আলী আকবরসহ তাঁর স্বজনেরা মিশলুর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটিয়ে মারিয়াকে তাঁদের পরিবারে ফেরত নিতে নানাভাবে চেষ্টা করেন। এ নিয়ে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে সালিস বৈঠক হয়েছিল। এতে মিশলু মারিয়ার চাচা আলী আকবরসহ তাঁর স্বজন ও প্রতিপক্ষের ওপর ক্ষুব্ধ হন।
মারিয়ার পরিবারকে উচিত শিক্ষা দিতে মিশলু ও তাঁর ভাই তাজুল ভূঁইয়া পরিকল্পনা করেন, নিজেদের ফুফুকে খুন করে ওই মামলায় মারিয়ার স্বজন ও প্রতিপক্ষকে ফাঁসাবেন।
সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী মিশলু, তাঁর ভাই তাজুল, চাচা, চাচাতো ভাই ও খালাতো ভাইদের নিয়ে গত বছরের ১৮ জুলাই নিজ বাড়িতে ফুফু জিনারা খাতুনকে খুন করেন। মিশলুর বাবা মো. খুর্শিদ ভূঁইয়া (৬৪) ঘটনার সময় বাড়িতে ছিলেন না। তিনি খবর পেয়ে বাড়িতে এসে দেখেন, তাঁর ছোট বোন জিনারার রক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে। তখন মিশলুসহ সবাই মিলে তাঁর বাবাকে বলেন, মারিয়ার স্বজনেরা মারিয়াকে জোর করে তাঁদের বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইলে জিনারা বাধা দেন। তখন তাঁরা জিনারাকে কুপিয়ে হত্যা করেন এবং তাঁদেরও আহত করেন।
এরপর মিশলু তাঁর বাবাকে (মো. খুর্শিদ ভূঁইয়া) দিয়ে মারিয়ার চাচা স্থানীয় মেম্বার আলী আকবরসহ প্রতিপক্ষের ২০ জনকে আসামি করে অষ্টগ্রাম থানায় সাজানো মামলা করান। মামলায় বলা হয়, মারিয়ার পরিবারের লোকজনের হামলায় মিশলু, তাঁর ভাই, চাচা, চাচাতো ভাই ও খালাতো ভাইয়েরা আহত হয়েছিলেন। আর মিশলু তাঁর স্ত্রীসহ স্বজনদের ওই মামলার সাক্ষী করা হয়।
প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে আসামিরা কেন হত্যার জন্য জিনারাকে বেছে নিলেন, এ প্রশ্নের জবাবে তদন্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী বলেন, স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর জিনারা মিশলুদের বাড়িতে থাকতেন। তিনি তাঁদের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। সে কারণে জিনারাকে হত্যা করাটা নিরাপদ বলে তাঁরা মনে করেছিলেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক জুলফিকার আলী জানান, দীর্ঘদিন বেকার থাকায় মিশলু মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। প্রতিপক্ষের আসামিদের ধরিয়ে দেওয়ার কথা বলে তিনি তাঁদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করতেন। মিশলু ও তাঁর ভাই পরিকল্পনা করে তাঁদের সাজানো মামলায় সাক্ষ্য দিতে মারিয়াকে কড়া পাহারা ও চাপে রাখতেন। গত বছরের সেপ্টেম্বরে মিশলু এজাহারভুক্ত আসামি জয়নাল মিয়াকে সিআইডির হাতে তুলে দেন। এ ঘটনার পর থেকে মারিয়ার মধ্যে অনুশোচনা তৈরি হতে থাকে।
একপর্যায়ে মারিয়া সিআইডির কাছে প্রকৃত ঘটনা খুলে বলেন। পরে তিনি সাক্ষী হিসেবে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও দেন। এরপর আদালত থেকে মারিয়া তাঁর বাবার বাড়িতে চলে যান। পরে জিনারা খাতুন হত্যায় সিআইডি গত এপ্রিলে মিশলু ও তাঁর আপন চাচা রশীদ ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করে।
সিআইডির এই তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, জিনারা হত্যাকাণ্ডে মিশলুদের পরিবারের ১০ জনের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। পালিয়ে থাকা আট আসামিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। আগের এজাহারভুক্ত সব আসামিকে মামলা থেকে অব্যাহতির সুপারিশ করে হত্যায় জড়িত ১০ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।