মা–বাবা ও বন্ধুদের কোলে চড়ে, কখনো হুইলচেয়ার বা স্টিলের লাঠিতে ভর করে পড়াশোনা করেছেন মো. ইমতিয়াজ কবির (২৪)।
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে গত জুন মাসে প্রতিবন্ধকতাজয়ী ইমতিয়াজ তাঁর কর্মজীবন শুরু করেছেন।
সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক জাপানি তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি কোডল্যাব এফজেডসির ঢাকা অফিসে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করছেন ইমতিয়াজ। বেতনও পাচ্ছেন ভালো।
গত শনিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে আসেন ইমতিয়াজ ও তাঁর মা ইয়াসমিন নাহার। মা-ছেলে শোনান তাঁদের সংগ্রামের গল্প।
চাকরি পেয়েই ইমতিয়াজ চট্টগ্রামে থাকা তাঁর মা ইয়াসমিনকে ফোন করেছিলেন। ফোনে দারুণ উচ্ছ্বাস নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আম্মু, আমি চাকরি পেয়েছি।’
ছেলের মুখে তাঁর চাকরি পাওয়ার খবর শোনার অনুভূতি কেমন ছিল, জানতে চাইলে ইয়াসমিন বলেন, ‘এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই। অন্য কোনো মা এই অনুভূতি বুঝতে পারবেন না।’
সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে একপর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মা-ছেলে। তখন আবার একজন আরেকজনকে সান্ত্বনা-সাহস দিতে থাকেন।
ইয়াসমিনদের বাড়ি নড়াইলে। তবে তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রামে বসবাস করে আসছেন। ছেলে ইমতিয়াজের ঢাকায় চাকরি হওয়ায় তাঁর সবকিছু গুছিয়ে দিতেই মা চট্টগ্রাম থেকে রাজধানীতে এসেছিলেন।
একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় ইনামুল কবীরের সঙ্গে ইয়াসমিনের বিয়ে হয়। তাঁরা স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কে মামাতো-ফুফাতো ভাই–বোন।
ইয়াসমিন ২০১৩ সাল থেকে চট্টগ্রামের কৃষ্ণকুমারী সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। তবে তাঁর চাকরি এখনো স্থায়ী হয়নি। তাঁর স্বামী ইনামুল একসময় পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। তবে শারীরিক অসুস্থতার কারণে ২০১৮ সালের পর তাঁর পক্ষে পূর্ণকালীন এই চাকরি আর চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। বর্তমানে তিনি খণ্ডকালীন একটি কাজ করছেন। ইয়াসমিন-ইনামুল দম্পতির এক মেয়ে এখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। ছেলে ইমতিয়াজ চাকরি পাওয়ায় পরিবারটি নতুন করে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে।
ইয়াসমিন যখন স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে পড়েন, তখন ইমতিয়াজের জন্ম হয়। পরে ইয়াসমিন অ্যাকাউন্টিংয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।
জন্মগতভাবেই ইমতিয়াজের ডান পা বাঁকা ছিল। পরে দেশে-বিদেশে তাঁর চিকিৎসা করানো হয়। পায়ে দেওয়া হয় প্লাস্টার। প্লাস্টার খোলার সময় তাঁর পা ভেঙে যায়। পরে তাঁর দুই পায়েই সমস্যা দেখা দেয়। মেরুদণ্ডের হাড়েও সমস্যা দেখা দেয়। এইচএসসি পরীক্ষার আগে একবার তাঁর শরীরের পুরো বামপাশ অবশ হয়ে গিয়েছিল। ইমতিয়াজ সোজা হয়ে বসতে পারেন না। হাতেও পুরোপুরি শক্তি পান না।
মা ইয়াসমিন বলেন, একপর্যায়ে ছেলের শারীরিক সীমাবদ্ধতার বিষয়টি মেনে নেন। মনস্থির করেন, প্রতিবন্ধকতার কারণে ছেলে যাতে কোথাও পিছিয়ে না পড়ে। ছেলেকে ভালো স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। নিজের শারীরিক কষ্ট ভুলে পড়াশোনার জন্য ছেলেকে কোলে নিয়ে পাঁচতলায় পর্যন্ত উঠেছেন। আর ছেলের মধ্যেও জীবনে ভালো কিছু করার প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি সব সময় কাজ করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগপর্যন্ত ইমতিয়াজ মা–বাবার সঙ্গে চট্টগ্রামেই ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর তাঁর সংগ্রাম আরও বাড়ে। সিলেটে এক বছর তাঁর পাশে ছিলেন এক ফুফু ও ফুফাতো ভাই। পরে মেসে থাকেন তিনি। করোনার সময় বাসায় থেকে পড়াশোনার সুযোগ হয় তাঁর।
ইমতিয়াজ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার সময় বন্ধুরা, বিশেষ করে আশরাফ তাসীন তাঁকে কোলে করে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেতেন। এই বন্ধুই তাঁকে লাঠিতে ভর দিয়ে কীভাবে হাঁটতে হয়, তা শিখিয়েছেন।
ইমতিয়াজের অফিস রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়। তিনি বর্তমানে মিরপুরে চাচার বাসায় থাকছেন। পাঠাওয়ের একজন মোটরসাইকেলচালক তাঁকে অফিসে আনা-নেওয়া করেন। যেদিন এই চালক থাকেন না, সেদিন লাঠিতে ভর দিয়ে নিজেই অফিসে আসা-যাওয়া করেন। অফিসের সহকর্মীরা তাঁকে সহায়তা করেন।
ইমতিয়াজ বলেন, ‘আমি একা চলাচল করতে পারব—এই সাহস ও আত্মবিশ্বাস আমার মধ্যে তৈরি করে দিয়েছে বন্ধু আশরাফ। তাঁর প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
ইমতিয়াজকে নিয়ে সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে মা ইয়াসমিন বলেন, ‘মা-ছেলের জীবনের লড়াই-সংগ্রামের গল্পটা দীর্ঘ। কোনটা রেখে কোনটা বলব? একটা ঘটনা বললে মনে হয়, অন্য ঘটনাটা তো বলা হলো না।’
ইমতিয়াজ জানান, স্কুল-কলেজে পড়ার সময় তাঁর মা-বাবা আগের দিনই ঠিক করে নিতেন, কে তাঁকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়ে যাবেন, আর কে নিয়ে যাবেন কোচিংয়ে।
ইমতিয়াজ বলেন, ‘স্কুল-কলেজে পড়ার সময় আমাকে কোলে নিলে আম্মুর যে কষ্ট হতো, তা আমি বুঝতে পারতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমি লাঠিতে ভর দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় আম্মুর কষ্টটা বেশি করে অনুভব করেছি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য পরীক্ষা দিতে খুলনা, রাজশাহী, সিলেটসহ বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছিলেন জানিয়ে ইমতিয়াজ বলেন, ‘তখন বাবা আমাকে কষ্ট করে নিয়ে গেছেন। তিনি আমাকে সাহস দিয়ে বলতেন, আমি পারব।’
ইয়াসমিন বলেন, এত বড় ছেলে কোলে—এটা দেখলে অনেক বাসচালক-সহকারীরা তাঁদের নিতে চাইতেন না। বাসে আসন ফাঁকা আছে। তবুও তাঁরা তুলতেন না। একপর্যায়ে ছেলেকে একটু দূরে বসিয়ে রেখে বাস থামিয়ে ওঠার চেষ্টা করতেন তিনি।
ইয়াসমিন একসময় একটি কোরীয় কোম্পানিতে চাকরি করতেন। ইমতিয়াজ তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত। সে সারা দিন মাকে কাছে পেত না। একদিন সে ইয়াসমিনকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার কথা বলেছিল। তারপর ইয়াসমিন চাকরিটি ছেড়ে দেন। পরে স্কুলের চাকরি ও টিউশনি শুরু করেন।
কোরীয় কোম্পানিতে চাকরি করার সময় ইয়াসমিন তাঁর ছেলের চিকিৎসার জন্য অর্থ জমাতে থাকেন। তিনি বলেন, ‘ছেলের চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার কথা ভেবে আমি ডলার কিনে রাখতাম।’
ইয়াসমিন বলেন, এই পর্যন্ত আসতে ছেলে অনেক কষ্ট করেছে। পাশে বসা ছেলে বলেন, ‘মা আমাকে নিয়ে অনেক সংগ্রাম করছেন। তাই মায়ের কষ্টের কথা চিন্তা করে আমিও জীবনে ভালো কিছু করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছি।’
হাসপাতালে স্বাভাবিক জন্ম হয়েছিল ইমতিয়াজের—এ কথা জানিয়ে ইয়াসমিন বলেন, প্রথমদিকে পরিবারের সবাই সান্ত্বনা দিয়ে বলতেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ঠিক হয়নি। তিনিসহ পরিবারের সদস্যরা একপর্যায়ে ইমতিয়াজের প্রতিবন্ধকতা মেনে নেন। কিন্তু পাড়াপড়শিসহ অন্য মানুষ ইমতিয়াজকে নিয়ে নানা কথা বলতেন।
ইয়াসমিন বলেন, ‘ছেলেকে কোলে করে পাঁচতলায় কোচিং সেন্টারে নেওয়ার পর একজন অভিভাবক বলেছিলেন, শুধু শুধু এত কষ্ট কেন করছি, ও কী আর ভালো কোথাও চান্স পাবে? কোনো প্রতিবন্ধী স্কুলে ভর্তি করালেই তো হয়! প্রতিটি পদে পদে শুনতে হয়েছে, ছেলেকে আরও পড়াব কি না। অনেক সময় কষ্ট পেয়েছি। অনেক সময় প্রতিবাদ করেছি।’
তবে চলার পথে অনেকে সহায়তা-সমর্থন দিয়েছেন বলে জানান ইয়াসমিন। তিনি বলেন, ‘এ কারণেই ছেলে আজ একটা পর্যায়ে আসতে পেরেছে। একবার ছেলের ভোটার আইডি কার্ড করতে যাই। তখন একজন কর্মকর্তা দাঁড়িয়ে আমাকে স্যালুট দিয়েছিলেন। তখন আনন্দে চোখে পানি চলে এসেছিল।’
ইমতিয়াজকেও নানা কথা শুনতে হয়েছে। তা ছাড়া মা ইয়াসমিনকে বলা কথাও তাঁর কানে আসত। ইমতিয়াজ বলেন, ‘পরীক্ষায় কেন বাড়তি সময় নিচ্ছি, কেন সায়েন্স নিলাম, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবো নাকি, এমন সব কথা অনেকে বলত।’
কোনো পরিবার যাতে প্রতিবন্ধী সন্তানকে অবহেলা না করে, সেই অনুরোধ জানান ইয়াসমিন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পড়াশোনা, চাকরিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকার যাতে আর একটু সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়, সেই অনুরোধও জানালেন এই মা।
অন্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উদ্দেশে ইমতিয়াজ বলেন, প্রতিবন্ধকতাকে সহজভাবে নিতে হবে। হতাশ হলে সামনের দিকে আগানো যাবে না। পরিবারের পাশাপাশি নিজের আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে। নিজের ভেতরের শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে।
মায়ের কাছে লেখাপড়ায় হাতেখড়ি হয় ইমতিয়াজের। মা ইয়াসমিন বলেন, তিনি সব সময়ই ছেলেকে নিয়ে গর্ববোধ করেন। ছেলে প্রতিবন্ধী কোটা ছাড়াই ভালো স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে। এখন নিজের যোগ্যতায় চাকরি করছে।
ইয়াসমিন বলেন, ‘আমাদের অবর্তমানে ছেলেকে কে দেখবে, সে চিন্তা থাকলেও এখন ভয়টা একটু কমেছে। ছেলে নিজেই চলাচল করতে পারবে। ছেলে সংসার করছে, আমার এই ইচ্ছাটা পূরণ হোক, তা চাই।’
ইমতিয়াজ বলেন, ‘ছোটবেলায় মা কোলে করে আমাকে স্কুলে নিয়ে যেতেন। এই দৃশ্য দেখে স্কুলের অন্য শিক্ষার্থীরা বলত, এত বড় ছেলে কোলে চড়ে! এতে আমার কান্না পেত। আম্মুকে যখন লোকজন নানা কথা বলত, তা শুনেও কষ্ট লাগত। পরে দেখা যেত, আমি আম্মুকে, আর আম্মু আমাকে সান্ত্বনা দিত। একটা সময় বুঝে যাই, এটাই আমার জীবন। সব সময় মনে হতো, আমাকে সব বাধা পেরিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছাতেই হবে। আম্মু যদি এত কষ্ট করতে পারেন, আমি কেন পারব না! এখন আমি একটা ভালো চাকরি করছি। তবে আমাদের জার্নিটা সহজ ছিল না।’