বিরোধী দলের সরকারবিরোধী আন্দোলন ও ক্ষমতাসীনদের নির্বাচনমুখী তৎপরতা—দুই পক্ষেরই রাজপথ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় আবারও জোট-মহাজোটের তৎপরতা বেড়েছে। ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল—উভয় শিবিরই নামসর্বস্ব দলকে কাছে ভেড়াচ্ছে। সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার ক্ষমতাসীন ১৪-দলীয় জোটের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন ৫৮টি দলের একটি ‘ঢাউস’ জোটের প্রতিনিধিরা।
এই জোটের দলগুলোর প্রায় সবই ‘অচেনা’, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৭ সালে প্রয়াত এইচ এম এরশাদের সঙ্গে তারা জোটবদ্ধ হয়েছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর আর এই জোটের অস্তিত্ব দেখা যায়নি। ৫৮–দলীয় এই জোটের নাম সম্মিলিত জাতীয় জোট (ইউএনএ)। জোটের অন্তর্ভুক্ত দলগুলোর নামও বেশ বাহারি।
গতকাল রাতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আমির হোসেন আমুর সঙ্গে সম্মিলিত জাতীয় জোটের প্রতিনিধিদের বৈঠকের তথ্য জানানো হয়।
এতে বলা হয়, আমির হোসেন আমুর নিউ ইস্কাটনের বাসায় ৫৮–দলীয় জোটের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকের শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং চলমান রাজনীতিতে দল ও জোটসমূহের ভূমিকা ও করণীয়’।
আওয়ামী লীগের দপ্তর থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এবং কেন্দ্রীয় ১৪ দলের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র আমির হোসেন আমু। সম্মিলিত জাতীয় জোটের পক্ষে মহাসচিব খন্দকার মো. ইমদাদুল হক ১০ সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সরকারের কোনো কোনো মহল এইচ এম এরশাদ মারা যাওয়ার পরও অচেনা এসব দলের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিল। তাদের উদ্যোগেই সংসদে বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদের সঙ্গে ৫৮ দলের এই জোটকে ভেড়ানো হয়েছে। গতকাল আমির হোসেন আমুর সঙ্গে বৈঠকে জোটের প্রতিনিধিরা তাঁদের চেয়ারম্যান হিসেবে রওশন এরশাদের নাম বলেন।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে আমির হোসেন আমু প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎকারীদের আলাদা জোট হিসেবে তৎপরতা চালাতে পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁদের জোটের কোনো কর্মসূচিতে ডাকলে তিনি অংশ নেবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। ১৪ দলের সমন্বয়ক আরও বলেন, ৫৮ দলের জোটের প্রধান হিসেবে রওশন এরশাদ আছেন, সেটা তাঁকে প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বৈঠকে দেশের স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাওয়ার সিদ্ধান্ত¯গৃহীত হয়। সম্মিলিত জাতীয় জোটের নেতারা চলমান সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে ১৪–দলীয় জোটের সঙ্গে একযোগে কাজ করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
বৈঠকে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সম্মিলিত জাতীয় জোটের মুখপাত্র আলতাফ হোসাইন মোল্লা, জোটের প্রধান সমন্বয়কারী শাহ ওয়ালিউল্লাহ ফরহাদ, ডেমোক্রেটিক পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমান, জাতীয় জনতা পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান, জাতীয় ওলামা মাশায়েখ পার্টির চেয়ারম্যান শরিফ হাজারী, বাংলাদেশ ইসলামিক জনতা পার্টির চেয়ারম্যান মো. আজহারুল ইসলাম, গ্রামীণ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হায়দার আলী, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা পার্টির চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সালেহ্ মো. ফিরোজ মল্লিক, ইসলামিক সমাজতান্ত্রিক পার্টির চেয়ারম্যান তালিবুল ইসলাম প্রমুখ।
দীর্ঘদিন ধরেই ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশসহ কিছু কিছু ইসলামপন্থী দল ১৪ দলে অন্তর্ভুক্ত হতে চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু জোটের বাম দলগুলো ও ইসলামপন্থী তরিকত ফেডারেশন এর জোরালো বিরোধিতা করে আসছে। ফলে ১৪ দলে অন্যদের অন্তর্ভুক্তি না করার বিষয়ে শীর্ষ নেতৃত্ব একমত হন। সর্বশেষ ১৯ জুলাই গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্ব ১৪ দলের সভায় ১৪ দল সম্প্রসারণ না করার বিষয়ে আলোচনা হয়। তবে অন্যান্য দলের সঙ্গে নির্বাচনী ঐক্য গড়ার ওপর জোর দেওয়া হয়।
গতকাল আমির হোসেন আমুর সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেওয়া ৫৮ দলের সম্মিলিত জাতীয় জোটে ইসলামিক ফ্রন্ট নেই। এই জোটের দলগুলোর নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনও নেই। অধিকাংশ দলের কার্যালয়ও খুঁজে পাওয়া যায় না বলে জানা গেছে।
এই জোট যখন গঠন করা হয়েছিল, তখন জোটের দলগুলোর নাম নিয়েও ‘হাস্যরসের’ সৃষ্টি হয়েছিল। যেমন প্রতিবাদী জনতা পার্টি, আমজনতা পার্টি, জনতা ফ্রন্ট, ইসলামি মূল্যবোধ সংরক্ষণ পার্টি, খেদমতে খালক পার্টি, সচেতন হিন্দু পার্টি, বাংলাদেশ গ্রামীণ পার্টি। ইসলামপন্থী দলের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ খেলাফত সংগ্রাম পরিষদ, বাংলাদেশ ইসলামিক জনকল্যাণ পার্টি, জাতীয় শরিয়া আন্দোলন, হেফাজতে মুসলেমিন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফাতুল উম্মাহ, বাংলাদেশ আকিমুদ্বীন মজলিশ ইত্যাদি।
বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪৭টি। সম্মিলিত জাতীয় জোটের কোনো দলের নিবন্ধন থাকার তথ্য জানা যায় না।
২০১৭ সালের মে মাসে এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টির সঙ্গে জোট করা হয়। জাতীয় প্রেসক্লাবে এরশাদ উপস্থিত থেকে ‘ঢাউস’ এই জোটের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংখ্যার দিক থেকে এত বড় জোটের খবর জানা যায় না। এইচ এম এরশাদ মারা যাওয়ার পর থেকে জাতীয় পার্টিতে রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরের মধ্যে দূরত্ব রয়েছে। দেবর-ভাবির এই দূরত্বে রওশনকে সরকার সমর্থক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জাতীয় পার্টি আগামী নির্বাচন বর্জন করলে রওশনের নেতৃত্বে ৫৮–দলীয় জোটকে মাঠে নামানোর পরিকল্পনা রয়েছে বলে সরকারি বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে।