ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিনেটের বার্ষিক অধিবেশনে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে ‘গেস্টরুম নির্যাতন’ নিয়ে দেওয়া বক্তব্য এক্সপাঞ্জ (প্রত্যাহার) করেন সিনেটের চেয়ারম্যান ও উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান। এর প্রতিবাদে অধিবেশন থেকে ওয়াকআউট করেন বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলের আহ্বায়ক মো. লুৎফর রহমান ও আরেক শিক্ষকনেতা অধ্যাপক এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম।
আজ বুধবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে সিনেটের বার্ষিক অধিবেশন চলাকালে এ ঘটনা ঘটে।
এর আগে অধিবেশনে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯১৩ কোটি ৮৯ লাখ ৮৭ হাজার প্রস্তাবিত পরিচালন বাজেট উপস্থাপন করেন কোষাধ্যক্ষ মমতাজ উদ্দিন আহমেদ। এরপর পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দেন শিক্ষকেরা। উল্লেখ্য, সিনেটের তিনটি পদ বাদে সব কটিতেই এখন আছেন আওয়ামীপন্থী শিক্ষকেরা।
লুৎফর রহমান অধিবেশনের বক্তব্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে ‘গেস্টরুম নির্যাতন’ নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, হলগুলোতে গেস্টরুমে ছাত্রদের নির্যাতন করা হয়, বিরোধী মতের ছাত্রদের এখানে দাঁড়াতে দেওয়া হয় না। এই গণতন্ত্র ও মূল্যবোধ নিয়ে কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিশেষ মর্যাদা দাবি করা যায়, সেই প্রশ্ন তোলেন তিনি।
তবে গেস্টরুমে ছাত্রদের নির্যাতন প্রসঙ্গে কথা বলার আগে পরিসংখ্যান বিভাগের এই শিক্ষক বাজেটে গবেষণায় বরাদ্দ আরেকটু বাড়ানোর আহ্বান জানান। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের মল চত্বরে শতবর্ষের স্মৃতিস্তম্ভের কাজ দ্রুত শেষ করা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেতে পিএইচডির বাধ্যবাধকতার বিষয়টি আসন্ন ১ জুলাই থেকে কার্যকর না করে ২০২৫ সালের ১ জুলাই থেকে কার্যকর করা এবং বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে অ্যালোয়েন্স বাড়ানোর দাবি জানান তিনি। কিছু উদ্যোগের জন্য উপাচার্যকে ধন্যবাদও দেন লুৎফর।
তবে ‘গেস্টরুম নির্যাতন’ নিয়ে তাঁর দেওয়া বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করার দাবি জানান নীল দলের সাবেক আহ্বায়ক মো. আবদুস ছামাদ। অধ্যাপক লুৎফরের বক্তব্য নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখান শিক্ষক সমিতির সভাপতি নিজামুল হক ভূঁইয়া ও শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের প্রাধ্যক্ষ আবদুর রহিমও। রহিম বলেন, ‘অছাত্রদের হলে থাকার সুযোগ নেই। আমি একটি হলের প্রাধ্যক্ষের দায়িত্বে আছি। ছাত্ররা কেউ কখনো আমার কাছে অভিযোগ করেনি যে তারা হলে থাকতে পারছে না। অছাত্র-অপরাধীরা তো ক্যাম্পাসে আসতে পারার কথা নয়। হল নিয়ে ভুল স্টেটমেন্ট দেওয়া হচ্ছে।’
হইচই কিছুটা থামলে অধ্যাপক লুৎফর রহমান বলেন, ‘ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনকে বলব, অন্য ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরাও তাদের ভাই। তাদেরও ক্যাম্পাসে দলীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনায় যেন তারা ভূমিকা রাখে।’
এরপর পয়েন্ট অব অর্ডারের দাঁড়িয়ে ‘গেস্টরুম নির্যাতন’ নিয়ে অধ্যাপক লুৎফরের দেওয়া বক্তব্য প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এম অহিদুজ্জামান। তখন উপাচার্যও লুৎফরের বক্তব্যকে ক্যাম্পাসের ‘নেতিবাচক চিত্রায়ণ’ বলে আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘এটি খুবই অসত্য। এসবের সঙ্গে আমরা পরিচিত নই। গেস্টরুমে অতিথিরা আসেন, বসেন।’
এ সময় বিএনপিপন্থী শিক্ষকনেতা এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম বলেন, ‘অধ্যাপক লুৎফরের বক্তব্য মনগড়া নয়। এগুলো বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও এসেছে। তাঁর বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করার যে দাবি তোলা হয়েছে, আমি তার নিন্দা জানাই।’ এর জবাবে আওয়ামীপন্থী শিক্ষকনেতা এম অহিদুজ্জামান বলেন, ‘এটা কোনো রাজনৈতিক বক্তব্যের প্ল্যাটফর্ম নয়। এটা (লুৎফরের বক্তব্য) সিনেটের ভাষা নয়। তাই শব্দটি (গেস্টরুম নির্যাতন) প্রত্যাহার করার অনুরোধ করি। নীল দলের অন্য শিক্ষকেরাও একই ধরনের কথা বলতে থাকেন।’
এর এক পর্যায়ে সিনেট চেয়ারম্যান ও উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘অসংসদীয় শব্দগুলো সিনেটের প্রসিডিংস থেকে প্রত্যাহার করা হলো। এখানে পত্রিকার রেফারেন্স দিয়ে কথা বলার প্রয়োজন নেই। আপনারা নিজেরাই তো ক্যাম্পাসে থাকেন।’
তখন লুৎফর রহমান বলেন, ‘গেস্টরুম নির্যাতন নিয়ে দেওয়া বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করলে আমি সিনেট অধিবেশনে থাকব না। আমার বক্তব্য এক্সপাঞ্জের প্রতিবাদে আমরা ওয়াকআউট করব।’ লুৎফর ও ওবায়দুল ইসলাম চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে আসন থেকে উঠে গেলে উপাচার্য তাঁদের বসার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু তাঁরা আর বসেননি। অধ্যাপক লুৎফর ও ওবায়দুল চলে যাওয়ার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী তাঁদের উদ্দেশে বলেন, ‘নিজেদের অবস্থান বিবেচনা করে কথা বলবেন। বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে সামনে এনে আমাদের অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। ছাত্রদল ও জাতীয়তাবাদী দল পরিকল্পিতভাবে ডাকসু নির্বাচন বন্ধ করেছিল।’
বিএনপিপন্থী দুই সদস্যের ওয়াকআউটের পর বক্তব্য দেন নীল দলের প্রবীণ সদস্য খন্দকার বজলুল হক। এরপর অধিবেশনে আধা ঘণ্টার জন্য বিরতি দেওয়া হয়।