কম দামে রাজউকের প্লট পাইয়ে দেওয়ার ফাঁদে ফেলে এক নারীর কাছ থেকে প্রায় ৯ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তার দেবাশীষ কুমার সাহা রাজউকের জরিপ সাথি (চেইনম্যান) পদে কর্মরত ছিলেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইমের (দক্ষিণ) উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন আজ বুধবার জানিয়েছেন, আগের রাতে রাজধানীর রামপুরা এলাকা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, এক নারীর বাবা-মা অসুস্থ থাকার সময় তাঁদের জমিজমা ও সম্পত্তি-সংক্রান্ত বিষয়ে তিনি রাজউকে যেতেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে দেবাশীষের পরিচয় হয়। দেবাশীষ তাঁর সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেন। পরে ওই নারীর বাবা মারা যাওয়ার পর তাঁর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। পরে দেবাশীষ ভুক্তভোগী নারীকে রাজধানীর ঝিলমিল ও পূর্বাচলে প্লট পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেন। ওই নারী প্রলোভনে পড়ে দুটি ফ্ল্যাট বিক্রি করে ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা, ১৫০ ভরি স্বর্ণ বিক্রির ১ কোটি ২০ লাখ টাকা, একটি প্লট বিক্রির ২ কোটি ১০ লাখ টাকা, সঞ্চয়পত্র বিক্রির ৫০ লাখ টাকা, প্রাইভেট কার বিক্রি করে ১০ লাখ, ওই নারীর পরিচিত এক বন্ধুকে প্লট দেওয়ার জন্য এক কোটি ৫০ লাখ, মন্দিরের প্লট তাঁকে বরাদ্দ দেওয়ার জন্য ৫০ লাখ এবং ঝিলমিল প্রকল্পের একটি প্লট তাঁর নামে লিখে দেওয়ার জন্য মিউচুয়্যাল ট্রাস্ট ব্যাংকের মাধ্যমে ৩০ লাখ টাকাসহ মোট ৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা দেবাশীষকে দেন। দেবাশীষ ২০১৯ থেকে ২০২২ সালের নভেম্বরের মধ্যে ওই নারীর কাছ থেকে এই টাকা নেন। তবে তিনি তাঁকে কোনো প্লট বুঝিয়ে দেননি।
উপকমিশনার ইকবাল হোসাইন বলেন, ওই নারী প্লট বুঝিয়ে দেওয়ার কথা বললে টালবাহানা শুরু করেন দেবাশীষ। তখন দেবাশীষের কাছে টাকা ফেরত চান তিনি। দেবাশীষ তা ফেরত দিতে অস্বীকার করেন। এরই একপর্যায়ে দেবাশীষ ভুক্তভোগী নারীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন। ওই ঘটনায় ভুক্তভোগী নারী বাদী হয়ে গতকাল রামপুরা থানায় প্রতারণার মামলা করেন। এরপর দেবাশীষকে গ্রেপ্তার করা হয়। আজ তাঁকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়। আদালত আগামীকাল রিমান্ড আবেদনের শুনানির দিন রেখে দেবাশীষকে কারাগারে পাঠিয়েছেন।
মামলায় ওই নারী অভিযোগ করেছেন, তিনি পাওনা টাকা ফেরত চাওয়ায় দেবাশীষ তাঁকে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা, আইনজীবী, সাংবাদিক, ছাত্রলীগ নেতাদের নাম ব্যবহার করে হুমকি দিতেন। গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর দেবাশীষ মালিবাগ চৌধুরীপাড়ায় তাঁর বাসায় এসে তাঁকে মারধর করেন এবং গলাটিপে হত্যার চেষ্টা চালান। দেবাশীষ তাঁর তলপেটে লাথিও মেরেছিলেন। তখন তিনি দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন।
যোগাযোগ করা হলে ওই নারী আজ প্রথম আলোকে বলেন, রাজউকের উত্তরায় তাঁর বাবার নামে একটি প্লট ছিল। সেই প্লটের মালিকানা তাঁর নামে করার জন্য তিনি রাজউকে যান। তখন তাঁর সঙ্গে দেবাশীষের পরিচয়। দেবাশীষ তাঁর নামে প্লটের মালিকানা করে দেওয়ার আশ্বাস দেন। পরে দেবাশীষ রাজউকের প্লট কিনে দেওয়ার কথা বলে তাকে ফাঁদে ফেলেন। প্রতারক দেবাশীষ কৌশলে তাঁর ছবি তুলে তাঁর কাছ থেকে এতগুলো টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম সূত্র জানায়, প্রাথমিক তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, দেবাশীষ চাকরি করার সুযোগ নিয়ে রাজউকে আসা ব্যক্তিদের সঙ্গে পরিচিত হতে থাকেন। তিনি পরিকল্পনা করে নারীদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতেন। সম্পর্ক ধরে রাখতে তিনি নানা ব্যক্তির বাসাবাড়িতে যাতায়াত করতেন। বিশেষ করে নারীদের নিশানা করে তাঁদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক করতেন। বিত্তশালী ও অভিভাবক নেই, এমন নারীদের সরলতা ও অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তাঁদের সম্পত্তির নানা তথ্য সংগ্রহ করতেন। পরে রাজউকের নানা স্থানে প্লট পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে বিভিন্ন সময় কৌশলে বড় অঙ্কের টাকা নিয়ে তা আত্মসাৎ করতেন। পরে প্রতারিত ব্যক্তি টাকা ফেরত চাইলে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তি, আইনজীবী, সাংবাদিক ও ছাত্রলীগ নেতাদের নাম ব্যবহার করে হুমকি দিতেন।
ডিবির উপকমিশনার ইকবাল হোসাইন বলেন, দেবাশীষ ক্যাসিনোয় জুয়া খেলতেন। এ জন্য তিনি কিছুদিন আগে নেপালে যান। সেখান থেকে দেশে ফেরার পথে তাঁর কাছে অনেক ডলার থাকায় নেপালের বিমানবন্দরে গ্রেপ্তার হন। সেখানে ২৩ দিন জেল খেটে তিনি দেশে আসেন।
দেবাশীষকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে রাজউক কর্তৃপক্ষ। আজ রাজউকের চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞার স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে বলা হয়, রাজউকের জরিপসাথি দেবাশীষ কুমার সাহার বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এতে রাজউকের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। এ ধরনের কার্যকলাপ রাজউকের চাকরিবিধিমালা মোতাবেক দায়িত্ব পালনে অবহেলা, অসদাচরণ ও প্রতারণার জন্য দেবাশীষ কুমার সাহাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো। তাঁর বিরুদ্ধে নিয়মিত বিভাগীয় মামলা করারও নির্দেশে দেওয়া হলো।