ভূমিকম্পে কাঁপছে দেশ: জাপান থেকে কী শিখতে পারে বাংলাদেশ

ভূমিকম্পে কাঁপছে দেশ: জাপান থেকে কী শিখতে পারে বাংলাদেশ

ঢাকায় এখন একটু ঝাঁকুনি লাগলেই মানুষ ভীত হয়ে পড়ছে। ভূমিকম্প হলো কিনা, সে খোঁজ নিচ্ছে। গত ২১ নভেম্বর সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল। এর উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদীর মাধবদীতে। এই ভূমিকম্পে বিভিন্ন ভবনে ফাটল ধরে এবং বিভিন্ন স্থানে ১০ জনের প্রাণহানি হয়। এছাড়াও, গত ২২, ২৩ ও ২৬ নভেম্বরসহ গত এক সপ্তাহেই ছয়বার ভূকম্পন হয়েছে বাংলাদেশে। ফলে মানুষের মন থেকে ভয় কাটছেই না। 

অথচ বাংলাদেশের কাছাকাছি রয়েছে এমন এক দেশ, যেখানে ভূমিকম্প কোনো বিরল ঘটনা নয়; বরং দৈনন্দিন জীবনের অংশ। দেশটির নাম জাপান। বছরে প্রায় দেড় হাজার ভূমিকম্প সেখানে নিয়মিত নথিভুক্ত হয়; সুনামির সতর্কতাও শোনা যায় হরহামেশাই। অথচ তাদের জীবনযাত্রা থেমে থাকে না। কারণ? প্রস্তুতি, সচেতনতা আর বিজ্ঞানভিত্তিক অবকাঠামো।

জাপান প্রশান্ত মহাসাগরের ‘রিং অফ ফায়ায়ে’ অবস্থান করছে, যেখানে ইউরেশিয়ান, ফিলিপাইন ও প্যাসিফিক তিনটি টেকটোনিক প্লেট মিলিত। ভূতাত্ত্বিকভাবে পৃথিবীর সবচেয়ে সক্রিয় এই অঞ্চলে বড় ছোট কম্পন হয়। ছোট ভূমিকম্পে মানুষ কিছুই টের পায় না, মাঝারি মাত্রার কম্পন সেখানে স্বাভাবিক ঘটনা, তবে ইতিহাসে মারাত্মক ভূমিকম্পের অভিজ্ঞতাও রয়েছে তাদের।

অন্যদিকে বাংলাদেশে ভূমিকম্প বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের মতো নিয়মিত নয়। তাই প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণের জায়গাটিও তুলনামূলক দুর্বল। সাধারণ মানুষের কাছে ভূমিকম্প কেবল কয়েক সেকেন্ডের এক ঝাঁকুনির অভিজ্ঞতা; তার বেশি জানা নেই।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্পের বিষয়ে জাপানের কাছ থেকে বাংলাদেশের অনেক কিছু শেখার আছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ূন আখতার মনে করেন, জাপানিরা ভয় পায় না শুধু সে কারণে যে তারা শত শত ভূমিকম্পের মধ্যে বাস করে। বরং ‘সচেতনতা’ আর ‘প্রস্তুতি’ এই দুটি তাদের মানসিক দৃঢ়তার ভিত্তি।

স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিবের ব্যাখ্যা আরও স্পষ্ট। তিনি বলেন, জাপানে একটি শিশু জন্মের পর থেকেই ভূমিকম্প শেখার যাত্রা শুরু হয়। স্কুলে নিয়মিত ড্রিল হয়, ডেস্কের নিচে আশ্রয় নেওয়া থেকে শুরু করে কোথায় দৌড়ে যাবে, সব শেখানো হয়।

প্রায় প্রতি ১৫ দিন পরপর এমন মহড়া হয়। এতে বাড়তি কোনো খরচ লাগে না, কিন্তু অভ্যাস হয়ে যায় জীবন রক্ষার কৌশলে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে স্কুল, কলেজ, অফিস সব জায়গায় নিয়মিত ড্রিল বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে।

জাপানে প্রত্যেক এলাকার মানুষ জানে তাদের নিকটতম আশ্রয়কেন্দ্র কোনটি। পার্ক, খেলার মাঠ কিংবা খোলা জায়গা সম্পর্কে তাদের সমূহ জ্ঞান রয়েছে। ভূমিকম্প শুরু হলে কোথায় ছুটতে হবে, সেটাও তারা ভালোভারে রপ্ত করে।

ঢাকাসহ বড় শহরগুলোয় খোলা জায়গা কমে যাওয়ায় বিপদ আরও বাড়ছে। ইকবাল হাবিব বলেন, নিরাপদ খোলা স্থান নিশ্চিত করা এবং সকলকে সে সম্পর্কে জানানো, এ দুটি কাজ দ্রুত করা প্রয়োজন।

জাপানে আকাশচুম্বী ভবনের সংখ্যা অগণিত। কিন্তু বড় কম্পনেও যেগুলো ভেঙে পড়ে না। কারণ, বিল্ডিংগুলো কাঁপে না, বরং দুলে ওঠে। এ দুলে ওঠাই ভবনকে রক্ষা করে।

টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ার জুন সাতো জানান, জাপানে ছোট কুঁড়ে ঘর থেকে বড় টাওয়ার, সব ভবনই ভূমিকম্প-সহনশীল হতে বাধ্য।

স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, বাংলাদেশেও সাধারণত সুউচ্চ ভবনগুলো বিল্ডিং কোড মেনে ভূমিকম্প সহনীয় হিসেবে নির্মাণ করা হয়। কিন্তু, অপেক্ষাকৃত ছোট ব্যক্তি মালিকানাধীন ভবনগুলোর ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড মানা হয় না এবং ভূমিকম্পের আঘাত সামলানোর মতো নির্মাণশেলী প্রয়োগ করা হয় না। এই ভবনগুলোই অপেক্ষাকৃত ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি। তাই জাপানকে অনুসরণ করে ‘অবকাঠামোগত নিরাপত্তা কার্যকর’ করার ওপর জোর দেন তিনি।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এমন বিষয়ে রেজিলিয়েন্স প্ল্যান বা পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা কার্যকর করা জরুরি। জাপানে আকাশচুম্বী ভবনগুলো টিকে থাকে কারণ তাদের নকশায় দুই ধরনের নিরাপত্তা বিবেচনা করা হয়। ১) ছোট ও মাঝারি কম্পনে যেন ভবনের কোনো ক্ষতি না হয়; ২) ভয়াবহ ভূমিকম্পেও যেন ভবন ধসে পড়ে মানুষের প্রাণহানি না ঘটে। 

এক্ষেত্রে ১৯২৩ সালের গ্রেট কান্তো ভূমিকম্প তাদের মানদণ্ড, যেখানে এক লাখ ৪০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়।

জাপানের ভবনগুলোকে ভূমিকম্পের শক্তি থেকে আলাদা রাখার প্রযুক্তির নাম সিসমিক আইসোলেশন। ভবনগুলো বিশাল রাবারের শক অ্যাবজরবারের ওপর দাঁড় করানো থাকে, যা কম্পনের ঝাঁকুনি ভবনে পৌঁছাতে দেয় না। ৩০–৫০ সেমি পুরু রাবার প্যাড কলাম ও ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যুক্ত থাকে।

এ ছাড়াও মোশন ড্যাম্পার (সাইকেলের পাম্পের মতো যন্ত্র, যাতে তরল থাকে); মেশ স্ট্রাকচার (বাঁকা হওয়া ঠেকানোর জন্য আন্তঃসংযুক্ত সাপোর্ট) ব্যবহার করা হয়। এতে ১৫০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত দুললেও ভবনের ওপরের কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।

টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার ও সহযোগী অধ্যাপক জুন সাতো বলেন, জাপানের টাওয়ার ব্লকগুলো সাধারণ ভবন নয়। দেশটিতে সব ভবন, ছোট বা অস্থায়ী হলেও ভূমিকম্প-সহনশীল হতে হয়।

ইঞ্জিনিয়াররা দুটি প্রধান পর্যায়ে স্থিতিস্থাপকতা নিয়ে কাজ করেন। প্রথম পর্যায় হলো স্বল্প মাত্রার ভূমিকম্প সহ্য করা। তেমন ভূমিকম্পে মেরামত করার মতো কোনো ক্ষতি হওয়ার কথা নয়। ভবনের নকশা এমনভাবে করা হয় যাতে এসব ভূমিকম্পে কোনো ক্ষতি না হয়। দ্বিতীয় পর্যায় হলো, ভয়াবহ ভূমিকম্প সহ্য করা, যা অপেক্ষাকৃত বিরল।

বাংলাদেশে সুউচ্চ ভবন এখনো তুলনামূলক কম হলেও ছোট-বড় বহু ভবন নির্মিত হয় কোড না মেনে। সবচেয়ে ঝুঁকিতে এসব ব্যক্তিমালিকানাধীন ভবন। বিশেষজ্ঞেরা তাই বলছেন, বিল্ডিং কোড কঠোরভাবে প্রয়োগ, নিয়মিত ড্রিল বাধ্যতামূলক করা, খোলা নিরাপদ স্থান নির্ধারণ, নির্মাণ আইন ভাঙলে কঠোর ব্যবস্থা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিশ্চিত করাই এখন অগ্রাধিকারের বিষয়।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023 EU BANGLA NEWS