অনিশ্চয়তার ভিড়ে নিজের পথ খুঁজে নেওয়া সহজ নয়। ৪৪তম বিসিএসের শিক্ষা ক্যাডারে (ইতিহাস) প্রথম হওয়া মাসফিকা রহমানের পথটাও এমনই ছিল—হঠাৎ থমকে যাওয়া, করোনা মহামারি, অসুস্থতা, পরিবারে বড় সন্তানের দায়িত্ব আর সেই সবকিছুর ফাঁক গলে আবার নতুন করে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে বেরিয়ে যে জীবন তাঁর শুরু হওয়ার কথা ছিল বিদেশে উচ্চশিক্ষার মাধ্যমে, সেটি করোনার কারণে থমকে গিয়েছিল। তারপর ধীরে ধীরে নিজের সক্ষমতার ওপর ভরসা করে এগিয়েছেন। বিসিএসে সফল হওয়া যেন একরকম জীবনের মোড়-বদল। মাসফিকা রহমান বলেন, ‘বিসিএস আমাকে অনেক নতুন জিনিস শিখিয়েছে। সবচেয়ে বড় শিক্ষা, এখানে কোনো শর্টকাট নেই।’ তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন গোলাম রব্বানী।
প্রশ্ন:
৪৪তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে (ইতিহাস) প্রথম হয়েছেন। অভিনন্দন। সাফল্যের কারণ কী? কীভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন?
মাসফিকা রহমান: ধন্যবাদ। আসলে বিসিএস আমার মূল পরিকল্পনা ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর আমার লক্ষ্য ছিল বিদেশে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা করা। সে জন্য স্নাতকের সময় (২০১৫-১৭) আন্তর্জাতিক ভাষা ইনস্টিটিউট থেকে কোরিয়ান ভাষাও শিখেছিলাম। কিন্তু স্নাতক শেষ করতে না করতেই করোনা শুরু হলো। পারিবারিক চাপ, দায়িত্ববোধ, অসুস্থতা—সব মিলিয়ে বিদেশে উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতি এলোমেলো হয়ে গেল। ২০২০ সালে করোনায় গুরুতর অসুস্থও হয়েছিলাম, তখন সত্যিই মনে হয়েছিল, কোনো পরিকল্পনাই আর বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে নতুন করে ভাবতে বসি। পরিবার ও বন্ধুরা সরকারি চাকরির দিকেই জোর দিচ্ছিল। নিশ্চয়তার কথা ভেবে বিসিএসের প্রস্তুতি শুরু করি। সেখান থেকেই আমার বিসিএস যাত্রা শুরু।
প্রশ্ন:
পড়াশোনার সময় বণ্টন কীভাবে করতেন? রুটিন বা পরিকল্পনা কেমন ছিল?
মাসফিকা: খুব কাঠামোগত কোনো রুটিন ছিল না। দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় কাজের বাইরে যত সময় পেয়েছি, পড়েছি। বিষয়ভিত্তিক পড়াকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। টপিক ধরে পড়তাম। অনেকেই সময় ভাগ করে পরিকল্পনা করেন; আমার ক্ষেত্রে তা হয়নি। তবে যা পড়েছি, মনোযোগ দিয়ে পড়েছি।

প্রশ্ন:
বিসিএস প্রস্তুতিতে কী বিশেষ কৌশল আপনার জন্য কাজ করেছে?
মাসফিকা: বিশেষ কোনো শর্টকাট নেই—এটাই সবচেয়ে বড় সত্য। আপনাকে লেগে থাকতে হবে। নিজের হাতে যতটুকু সময় আছে, সেটুকু কাজে লাগাতে হবে। এ ক্ষেত্রে পড়াশোনার ধারাবাহিকতা গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন:
সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় শক্তি কোনটি—সততা, একাগ্রতা, সময় ব্যবস্থাপনা, নাকি অন্য কিছু?
মাসফিকা: একাগ্রতা আর সময় ব্যবস্থাপনা। বিসিএসের সিলেবাস খুব নির্দিষ্ট নয়। একবার প্রিলিমিনারি শেষ করেই আবার আরেকটার জন্য প্রস্তুতি শুরু করতে হয়। লিখিত পরীক্ষার ফল এলে আবার মৌখিকের প্রস্তুতি—সব মিলিয়ে পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যায় না। তাই সময় ব্যবস্থাপনাটা খুব জরুরি।
প্রশ্ন:
প্রস্তুতির সময় সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ কোনটি ছিল?
মাসফিকা: ধৈর্য ধরে লেগে থাকা। একসময় মনে হতো, আরও কয়েক দিন সময় পেলে ভালো হতো। এমন অনুভূতি বারবার আসত। তখন নিজেকে বোঝাতাম, যা প্রস্তুতি নিয়েছি, সেটাই আমার সেরা। এতে মানসিক চাপ কমেছে।
প্রশ্ন:
মনোবল কমে গেলে নিজেকে কীভাবে চাঙা করতেন?
মাসফিকা: বিসিএস আমার জন্য নতুন অনেক কিছু জানার সুযোগ তৈরি করেছিল, এই ভাবনাই আমাকে এগিয়ে রেখেছে। পরিবারের চাপ, বন্ধুদের প্রস্তুতি—সব মিলিয়ে আমিও পড়াশোনায় ঢুকে যাই। লিখিত ব্যাচে ভর্তি হয়ে প্রথমে নিজেকে খুব দুর্বল মনে হয়েছিল। তখনই মনে হলো, আরও শিখতে হবে। প্রিলি ব্যাচে ভর্তি হয়ে দেখি অনেক কিছু জানার আছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল, ঠিক সময়ে পড়া শেষ করতে না পারা। কিন্তু হাল ছাড়িনি।
প্রশ্ন:
পড়াশোনার জন্য কোন বই, নোট বা উৎস আপনার বেশি কাজে এসেছে?
মাসফিকা: অনলাইনে বিভিন্ন শিক্ষকের ক্লাস করেছি। তাঁরা যেটা পড়তে বলতেন, সেটা গুরুত্ব দিয়ে পড়তাম। ফেসবুকের চাকরিসংক্রান্ত গ্রুপগুলোতেও ভালো ভালো উপকরণ পাওয়া যায়।
প্রশ্ন:
যাঁরা এখন বিসিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তাঁদের জন্য কী পরামর্শ?
মাসফিকা: বিসিএস একটি দীর্ঘ ও অনিশ্চিত যাত্রা। তাই প্রথমেই মানসিক প্রস্তুতি দরকার। একাগ্রতা, সময় ব্যবস্থাপনা এবং পরিশ্রম—এই তিনটি বিষয়ের ওপর ভরসা রেখে শুরু করা উচিত।
নিজের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে। প্রস্তুতির মাঝখানে বিশ্রাম নেওয়া যায়, কিন্তু বিরতি কখনো নয়। বিষয়ভিত্তিক পড়ায় শৃঙ্খলা থাকা জরুরি; একটা অধ্যায় শেষ না করে অন্যটায় যাওয়া যাবে না।
আর নিয়মিত মডেল টেস্ট দিতে হবে। দুর্বল জায়গাগুলো চিহ্নিত করে কাজ করলে প্রস্তুতি অনেক দৃঢ় হয়।
প্রশ্ন:
পরিবার বা সহপাঠীদের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল?
মাসফিকা: পরিবার ছিল সবচেয়ে বড় শক্তি। বিসিএস এত দীর্ঘ ও অনিশ্চিত যে এর শেষ কোথায়, কেউ বলতে পারে না। এ যাত্রায় পরিবার পাশে থাকা সত্যিই একধরনের সঞ্জীবনী শক্তি।
সহপাঠীদের সঙ্গও গুরুত্বপূর্ণ। একই পথে হাঁটতে হাঁটতে অনেকেই প্রতিযোগী হয়ে যায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা অনুপ্রেরণাই দেয়।
প্রশ্ন:
বিসিএসের পর আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
মাসফিকা: পেশাগত বিষয়ে খুব নির্দিষ্ট কিছু ভাবিনি। ব্যক্তিগত লক্ষ্য—সুস্থভাবে, স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন উপভোগ করতে চাই।
প্রশ্ন:
বিসিএস ভাইভা (সাক্ষাৎকার) নিয়ে বিশেষ কোনো পরামর্শ আছে?
মাসফিকা: ভাইভা অনেকটা ‘প্যান্ডোরা বক্স’। সব প্রস্তুতি নিয়েও হয়তো সঠিকভাবে বলতে পারবেন না, আবার কোনো প্রস্তুতি ছাড়াও ভালো করতে পারেন।
আমি মনে করি, ভাইভার সময় মানসিক ও শারীরিকভাবে সতেজ থাকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।