আইনি ভিত্তি ছাড়া জুলাই সনদ মূল্যহীন

আইনি ভিত্তি ছাড়া জুলাই সনদ মূল্যহীন

জুলাই সনদে সব রাজনৈতিক দল স্বাক্ষর করলেও এর আইনি ভিত্তি ছাড়া এটি মূল্যহীন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও পারস্পরিক আস্থার অভাব রয়েছে। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের অভিমত সনদ বাস্তবায়ন নিশ্চিত না হলে এ সনদটি মূল্যহীন। পরবর্তী নির্বাচিত সরকার যতক্ষণ পর্যন্ত না এটি বাস্তবায়ন করছে ততক্ষণ পর্যন্ত এটির কোনা কার্যকারিতা নেই। এছাড়া জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়টি রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নও দেখা দেয়।

শনিবার (২৫ অক্টেবর) জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সম্মেলন কক্ষে ইনিশিয়েটিভ ফর দ্য প্রমোশন অব লিবারেল ডেমোক্রেসি (আইপিএলডি)-এর উদ্যোগে “অন্তর্বর্তী সরকারের নিকট জনআশা” বিষয়ক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন৷

আজিম গ্রুপের চেয়ারম্যান, সাবেক সংসদ সদস্য ও আইপিএলডি ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি প্রকৌশলী মোহাম্মাদ ফজলুল আজিমের সভাপতিত্বে সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক ও আইপিএলডির নির্বাহী সদস্য ইকতেদার আহমেদ৷ 

সেমিনারটির সঞ্চালনার দায়িত্ব পালন করেন বেগম তাহামিন বানু, নির্বাহী সদস্য, আইপিএলডি।

সেমিনারে বক্তারা বলেন, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বর্তমানে যে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতাসীন তাদের কাজ যদিও স্বল্পতম সময়ের মধ্যে ন্যূনতম সংস্কার পরবর্তী সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন। সে আয়োজনের পথে তারা প্রকৃত অগ্রসরে কতটুকু আগ্রহী তা এখনো পরিষ্কার নয়। আর তাই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রকৃত চাওয়া কী তা যতক্ষণ পর্যন্ত নির্ধারিত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত দেশ ও জাতিকে অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকতে হবে। অনিশ্চিয়তা দেশের জন্য মঙ্গল নাকি অমঙ্গলজনক তা একমাত্র অন্তর্বর্তী সরকারের আগামী দিনের কর্মসূচি ও কার্যাবলীর ওপর নির্ভর করবে।

তারা বলেন, নির্বাচন প্রশ্নে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) নাকি বর্তমান প্রচলিত পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হবে এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়নি। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ উভয় কক্ষে পিআর পদ্ধতির পক্ষে। আবার কোনো কোনো রাজনৈতিক দল একমাত্র উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতির পক্ষে। সংবিধানের বর্তমান ব্যবস্থায় নারীদের জন্য সংরক্ষিত ৫০টি আসনের ক্ষেত্রে পিআর পদ্ধতি অনুসৃত হয়। সে বিবেচনায় উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি অনুসৃত হলে এবং নিম্নকক্ষে বিদ্যমান পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তা হয়তো অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।

জুলাই সনদ নিয়ে তারা বলেন, জুলাই সনদে আজ পর্যন্ত ২৫টি রাজনৈতিক দল স্বাক্ষর করলেও সনদ বাস্তবায়নে কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়নি। শুধু স্বাক্ষরকারী দলগুলোর নৈতিক দায়বদ্ধতা তৈরি হয়েছে। আইনি ভিত্তি আদায়ে যারা আন্দোলন করছে, তা যৌক্তিক। কারণ ক্ষমতায় গেলে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করবে, এ বিশ্বাস অনেকের মধ্যে নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও পারস্পরিক আস্থার অভাব রয়েছে। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের অভিমত সনদ বাস্তবায়ন নিশ্চিত না হলে এ সনদটি মূল্যহীন।

মূল প্রবন্ধে ইকতেদার আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির আবির্ভাবের পরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা নেওয়া হলেও বারবার এটি মুখ থুবড়ে পড়েছে। গণতান্ত্রিক চিন্তা, মূল্যবোধকে জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছে। দেশে নির্বাচন হয়েছে কিন্তু এখনও “গণতন্ত্র” সোনার হরিণ। জনআশা কখনো পূরণ হয়নি। গণঅভ্যুথান পরবর্তী সরকার (অন্তর্বর্তী) এর কাছে জন প্রত্যাশা সব দলের অংশ গ্রহণের মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দিতাপূর্ণ অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন। এ জনআশা পূরণ হবে কিনা তাও জনমনে সন্দেহ।

তিনি বলেন, জুলাই সনদে এমন অনেক বিষয় রয়েছে যা বিদ্যমান সংবিধানের পরিপন্থি। সে ক্ষেত্রে এটি কীভাবে বাস্তবায়ন হবে। কারণ সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন। এ আইনের পরিপন্থি যে কোনো আইন এমনিতেই বাতিল হয়ে যায়। আর তাই জুলাই সনদে সব রাজনৈতিক দল স্বাক্ষর করলেও এর আইনি ভিত্তি ছাড়া এটি মূল্যহীন। পরবর্তী নির্বাচিত সরকার যতক্ষণ পর্যন্ত না এটি বাস্তবায়ন করছে ততক্ষণ পর্যন্ত এটির কোনো কার্যকারিতা নেই।

এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দল জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে যে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করে তাতে অনেক প্রতিশ্রুতি থাকে কিন্তু নির্বাচন পরবর্তী দেখা যায় সে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে নানা ধরনের বাধা-বিপত্তির উদ্ভব হয়। জুলাই সনদে যদিও বলা হয়েছে নির্বাচিত সরকার সনদ বাস্তবায়ন করবে কিন্তু কী পদ্ধতিতে তা বাস্তবায়ন হবে সে বিষয়টি পরিষ্কার নয়।

ইকতেদার আহমেদ বলেন, সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার আবশ্যকতা রয়েছে। আগামী সংসদ নির্বাচনে কোনো দল এককভাবে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে তা কীভাবে বাস্তবায়ন হবে এটি একটি মৌলিক প্রশ্ন। তাছাড়া গণভোটে জুলাই সনদ অনুমোদিত হলেও তা যতক্ষণ পর্যন্ত না সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় অনুমোদিত না হয় এর বাস্তবায়ন কঠিন বাধার সম্মুখীন।

তিনি বলেন, এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় উপনীত হয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিন ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়ন বিষয়ে গণভোটের আয়োজনের কথা বললেও সে প্রশ্নে চূড়ান্তভাবে সমঝোতায় উপনীত হওয়া না গেলে এর বাস্তবায়ন দুরূহ। আর নির্বাচন অনুষ্ঠান বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে ফেব্রুয়ারি, ২০২৬ এর মধ্যে সম্পন্নের যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে তা আনুষ্ঠানিক ভোট পর্ব শেষ হওয়া পরবর্তী ফলাফল ঘোষিত না হওয়া পর্যন্ত জনমনে আশার সঞ্চারের পথে নানা প্রতিকূলতায় আবদ্ধ।

সভাপতির বক্তব্যে তিনি বলেন, নির্বাচন ও সংস্কার পাশাপাশি হওয়া উচিত। কোনটি আগে কোনটি পরে সেটি এখনো ঠিক হয়নি। তবে নির্বাচন আগে হওয়া উচিত। আমরা আইপিএলডি মনে করি নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠিত না হলে দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসবে না।

প্রসঙ্গত, ইনিশিয়েটিভ ফর দ্য প্রমোশন অব লিবারেল ডেমোক্রেসি (আইপিএলডি) একটি অরাজনৈতিক ও অলাভজক প্রতিষ্ঠান। শিক্ষা, সংস্কৃতি, প্রশাসন, সামাজিক ও মানবিক কাজে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন সুনামধারী ব্যক্তিদের সমন্বয়ে আইপিএলডি বোর্ড অব ট্রাস্টি গঠিত। ২০১৫ সালে এ প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয়। সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা, কর্মশালা, সেমিনার, প্রশিক্ষণ আয়োজন করা, গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা, সমধর্মী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা ও সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে উদার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মানসে আইপিএলডি প্রধানত কাজ করছে। উদার গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি গণতন্ত্র বিষয়ক ১৬ টি সেমিনার ও দুইটি গবেষণা কর্ম সম্পন্ন করেছে।

সেমিনারে আইপিএলডি-এর নির্বাহী সদস্য তাহামিন বানু, এহসান শামীম, ফয়জুল লতিফ চৌধুরীসহ গবেষক, সরকারের সাবেক সচিব, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, আইনবিদ, অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিক, ব্যবসায়ীসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023 EU BANGLA NEWS