যখন একটি বিশাল তিমি মারা যায়, তার দেহ গভীর সমুদ্রের অতলে ডুবে গিয়ে এক নতুন জীবনের উৎস হয়ে ওঠে। এই ঘটনাকে বিজ্ঞানীরা বলেন হোয়াল ফলস। যা একটি তিমির মৃত্যুর পর শুরু হওয়া এক বিস্ময়কর জীব বৈচিত্র্যপূর্ণ বাস্তুতন্ত্রের জন্ম দেয়। কিন্তু এই প্রাকৃতিক চক্র এখন হুমকির মুখে—জলবায়ু পরিবর্তন ও অক্সিজেন হ্রাসের কারণে।
ওয়াশিংটনের লেখক ওম্নিয়া সায়েদ তার গবেষণামূলক কাজ ও শিল্প বিশ্লেষণে তিমি পতনের বৈজ্ঞানিক এবং কাব্যিক তাৎপর্য তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, “একটি তিমির পতন শুধু মৃত্যুই নয়—এটি এক ধরনের রূপান্তর, যা মৃত্যুকে জীবনে পরিণত করে।”

তিমির মৃতদেহ সমুদ্রতলে পৌঁছানোর পর একে একে তিনটি ধাপে বাস্তুতন্ত্র গড়ে ওঠে:
১. মোবাইল স্ক্যাভেঞ্জার স্টেজ: হাঙর, হ্যাগফিশ, ও গভীর সমুদ্রের অন্যান্য শিকারি কয়েক মাস ধরে তিমির নরম টিস্যু খেয়ে ফেলে।
২. এনরিচমেন্ট অপরচুনিস্ট স্টেজ: মৃতদেহের আশেপাশের পলি ও হাড় জৈব পদার্থে সমৃদ্ধ হয়; সেখানে পলিকীট ও ছোট প্রাণীর ঘনবসতি গড়ে ওঠে।
৩. সালফোফিলিক স্টেজ: ব্যাকটেরিয়া তিমির হাড়ের লিপিড ভেঙে হাইড্রোজেন সালফাইড উৎপন্ন করে, যা দিয়ে নতুন ও বৈচিত্র্যময় সামুদ্রিক প্রাণী টিকে থাকে।
হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিদ ও তিমি পতনের ওপর শীর্ষ গবেষক ড. ক্রেইগ স্মিথ জানান, “আমরা এমন তিমির হাড় পেয়েছি যা ১ লাখ বছরেরও পুরনো। একটি তিমির পতন ৫০ বর্গমিটার এলাকাজুড়ে নতুন বাস্তুতন্ত্র তৈরি করতে পারে।”
এই প্রাকৃতিক ঘটনাটি শুধু বৈজ্ঞানিক নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্যপূর্ণও। শিল্পী এলেন গ্যালাঘার তার Whale Falls ও Aquajujidsu সিরিজে তিমি পতনের চিত্র তুলে ধরেছেন। যেখানে বিকৃত কাগজের স্তর তিমির মৃতদেহের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
গ্যালাঘার ও অন্যান্য আফ্রো-আমেরিকান শিল্পীরা ড্রেক্সিয়া নামের একটি কাল্পনিক পানির নিচের সভ্যতার ধারণার মাধ্যমে দাসজাহাজে মৃত্যুবরণকারী কৃষ্ণাঙ্গদের স্মরণ করেন। এই মিথ অনুযায়ী, যেসব গর্ভবতী আফ্রিকান নারীকে জাহাজ থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল, তাদের অনাগত সন্তানরা সমুদ্রের নিচে একটি নতুন সভ্যতা গড়ে তোলে।
শিল্প বিশ্লেষক ম্যাককিট্রিক বলেন, “এই কল্পনার মাধ্যমে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে মানব রূপ না দিয়ে সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রের অংশ হিসেবে ভাবা হয়, যা এক মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেয়।”
তবে এই বিস্ময়কর প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া আজ হুমকির মুখে। ড. স্মিথ সতর্ক করে বলেন, সমুদ্রের অক্সিজেন ন্যূনতম অঞ্চলের (OMZ) প্রসারণ গভীর সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রকে চরমভাবে প্রভাবিত করতে পারে। তিমি পতনের উপর নির্ভরশীল অধিকাংশ প্রাণী পর্যাপ্ত অক্সিজেন ছাড়া টিকে থাকতে পারে না।
বিশেষ করে প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তর-পূর্ব উপকূলে—আলাস্কা থেকে ক্যালিফোর্নিয়া পর্যন্ত এ হুমকি প্রকট। এমনকি দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলেও পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ হচ্ছে।
তিমি পতন আমাদের শেখায় যে, মৃত্যুও জীবনের এক উৎস। আফ্রোফিউচারিস্ট মিথ, শিল্পকর্ম, এবং গভীর সমুদ্রের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ মিলিয়ে উঠে আসে এক পুনর্জন্মের গল্প।
লেখক ওম্নিয়া সায়েদ বলেন, “এই ঘটনাগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ইতিহাস কেবল ক্ষতির নয়—বরং জীবনের সম্ভাবনারও অংশ।” একইভাবে, বিজ্ঞান ও শিল্প একযোগে আমাদের আহ্বান জানায়—শুধু এই চক্রের সৌন্দর্যে বিস্মিত না হয়ে, বরং একে রক্ষায় সক্রিয় হতে।
লেখা: ওম্নিয়া সায়েদ, লেখিকা ও সাংবাদিক
অনুসন্ধানে মনোনিবেশ করেছেন।
সূত্র: অ্যাটমস ডট আর্থ থেকে ভাবানুবাদ।