আইপি বন্ধ, পেঁয়াজ ‘চাঙ্গে’—বাড়ছে দাম

আইপি বন্ধ, পেঁয়াজ ‘চাঙ্গে’—বাড়ছে দাম

ভরা মৌসুমেও দামের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় অস্থির পেঁয়াজের বাজার। কোনো ঘাটতি নেই, তবু পণ্যটির দাম বাড়ছে।আর কারণ হিসেবে মজুত করে রাখা, আমদানির অনুমতি (আইপি) বন্ধ রাখা এবং রমজানে দাম বেশি পাওয়ার আশায় অপরিপক্ব পেঁয়াজ বাজারে বেশি সরবরাহ করায় পরিপক্ব পেঁয়াজ বাজারে কম আসার মতো বিষয়গুলোকে দায়ী করছেন পাইকার ও আড়তদাররা।

পেঁয়াজের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে পেঁয়াজচাষি, ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা সবাই প্রায় একই কথা বলছেন। তারা বলছেন, জমিতে এখন আর কোনো পেঁয়াজ নেই। সব পেঁয়াজ কৃষকের ঘরে উঠে গেছে। এসব পেঁয়াজের বেশিরভাগই কৃষক নিজেরা ও মজুতদারেরা কিনে সংরক্ষণ করছেন। ভবিষ্যতে দাম আরও বাড়বে, সে আশায় বাজারে তুলনামূলক কম পেঁয়াজ আনছেন। এসব কারণে পেঁয়াজের মৌসুম হওয়া সত্ত্বেও বাজারে পণ্যটির দাম বেড়ে গেছে।

এ ছাড়া বর্তমান দামকে যৌক্তিক উল্লেখ করে অতিরিক্ত মজুত ঠেকাতে সরকারকে সজাগ থাকার তাগিদ দিয়েছেন কৃষি অর্থনীতিবিদরা।

মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) রাজধানীর শ্যামবাজার, সুত্রাপুর, রায়সাহেব বাজারসহ বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, বর্তমানে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর পাড়া-মহল্লায় সব ধরনের পেঁয়াজ আরও ৫ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে যেসব পেঁয়াজ পাওয়া যাচ্ছে, তার বেশিরভাগ ফরিদপুর অঞ্চলের। তবে পাবনায় উৎপাদিত পেঁয়াজের দাম একটু বেশি। পাবনার পেঁয়াজ ৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া বাজারে এখন আমদানি করা পেঁয়াজ নেই বললেই চলে। দুই-এক দোকানে যা পাওয়া যায়, সেগুলোর কেজি ৫৫ টাকার আশপাশে।

শ্যামবাজারে পাইকারিতে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪২ থেকে ৪৮ টাকা কেজি দরে, যা রোজার ঈদের আগেও ছিল ২৫ থেকে ৩২ টাকা কেজি দরে।

পুরান ঢাকার পেঁয়াজের সবচেয়ে বড় আড়ত শ্যামবাজার। সেখানকার আড়তদাররা জানান, গত দুই সপ্তাহ ধরে পেঁয়াজের বাজার অস্থির। কারণ এখন আর জমিতে পেঁয়াজ নেই। সব পেঁয়াজ কৃষকের ঘরে উঠে গেছে। এসব পেঁয়াজের বেশির ভাগই কৃষকেরা সংরক্ষণের জন্য মজুত করেছেন। আবার অনেক মজুতদারও সংরক্ষণের জন্য পেঁয়াজ কিনেছেন। সে পেঁয়াজ তারা বাজার পরিস্থিতি দেখে বিক্রি করবেন। কৃষক ও মজুতদারেরা দাম বাড়ার আশায় বাজারে পেঁয়াজ কম ছাড়ছেন। এ ছাড়া চলতি বছর এখন পর্যন্ত দেশে ভারতীয় পেঁয়াজ তেমন আসছে না। এ কারণে দেশি পেঁয়াজের বেশ চাহিদা রয়েছে। এই সুযোগে কৃষকেরা কিছুটা দাম বাড়াতে পেরেছেন।

এ বিষযে মেসার্স নিউ বাণিজ্যালয়ের ম্যানেজার মো. শহিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, পেঁয়াজ মজুত করেছে, সেজন্য দাম বাড়ছে। কৃষক ও মধ্যস্বত্বভোগীরা এটা করেছে। ঈদের আগেও পাইকারিতে ৩০ থেকে ৩২ টাকা কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে। এখন সেটা ৪২ থেকে ৪৭ টাকা কেজি। তিন দিন আগে ছিল ৪৮ থেকে ৫০ টাকা। এক সপ্তাহ আগে ২১০০ থেকে ২২০০ টাকা মণ দরে পেঁয়াজ বেচাকেনা হয়েছে। এখন ১৮০০ থেকে ১৯০০ টাকা মণ আজকের বাজার। দাম বাড়ার ফলে বেচাবিক্রি কমে গেছে। বিভিন্ন লোকজন এ খাতে ঢুকে গেছে। মজুতদারি কমাতে পারলে সামনে পেঁয়াজের দাম কমবে। তবে কোরবানির ঈদে আমাদের পেঁয়াজের সংকট হবে না।

মেসার্স রাজিব বাণিজ্য ভাণ্ডারের প্রদেশ পোদ্দার বাংলানিউজকে বলেন, মুড়িকাটা পেঁয়াজের কৃষক এবার লোকসান গুনেছে। তাই কৃষক, গৃহস্থ ও বেপারিরা হালি পেঁয়াজ মজুত করছে। তারা এখন চাঙ্গে (বড় বা উঁচু মাচা) পেঁয়াজ রেখে দেবেন। একটু লাভের আশায় মাস দুই পর সেখান থেকে পেঁয়াজ আস্তে আস্তে বাজারে ছাড়বেন। এতেই চড়েছে বাজার। ফলে বিপাকে পড়ছেন ভোক্তারা।

তিনি বলেন, এপ্রিলের ১ তারিখ থেকে আমদানির অনুমতি (আইপি) বন্ধ আছে। দাম বাড়ার এটাও একটা কারণ। ফলে এখন পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে না। বাজারে এলসি মাল নেই। গৃহস্থ ও বেপারিদের কাছে পেঁয়াজ আছে প্রচুর। কোরবানির ঈদের আগে যদি আইপি আবার চালু করে, তখন হয়তো পেঁয়াজের দাম আবার কমবে। তা না হলে এরকমই এক দুই টাকা বাড়বে আবার কমবে। এর থেকে আর বেশি কমবে না।

ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলা থেকে পেঁয়াজ নিয়ে শ্যামবাজারে এসেছেন মো. এছাক শেখ। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, রোজার ঈদের আগে ১১০০ টাকা মণ বা সাড়ে ২৭ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি করেছি। এখন ৪৭ টাকা কেজি দরে বিক্রি করলেও লাভ হবে না। আজকে ১৫ বস্তা পেঁয়াজ নিয়ে এসেছি। এতে ট্রাক ভাড়া দিছি ১৬৬০ টাকা, কুলি ভাড়া ৬০০ টাকা। প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৬০ টাকার বেশি দরে বিক্রি করতে পারলে আমাদের চালান উঠবে।

এছাক শেখ আরও বলেন, একপাকি জমিতে (২৬ শতক জমি) ৩৫ থেকে ৪০ মণ পেঁয়াজ হয়। জমির ভাড়া দিতে হয় ২০ হাজার টাকা। শতাংশে ১০০০ টাকা বীজ লাগে। একপাকি জমি চাষে লাগে ৮০০ টাকা। তারপর জমিতে পেঁয়াজ বুনতে লাগে ১২ জন শ্রমিক ও ওঠাতে লাগে ১২ জন শ্রমিক। এরপর পরিচর্যা, সেচ ও ওষুধ খরচ মিলে অনেক খরচ। ফলে পেঁয়াজের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এখন দাম বাড়ায় উৎপাদন খরচ উঠছে। তবে পেঁয়াজের দাম মণপ্রতি ৩ হাজার (কেজি ৭৫ টাকা) না হওয়া পর্যন্ত আমরা লাভজনক অবস্থায় যেতে পারব না।

সুত্রাপুর বাজারের খুচরা পেঁয়াজ ব্যবসায়ী বলরাম বাংলানিউজকে বলেন, গত ২০ থেকে ২৫ দিন ধরে পেঁয়াজের দাম বাড়তি। বর্তমানে মান ভেদে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৫৫ থেকে ৬৫ টাকা। আর পাবনার পেঁয়াজ হলে ৭৫ টাকার ওপরে বিক্রি করছি। কৃষক ও আড়তদারের কাছ থেকে আমাদের বেশি দামে পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে। এ কারণে ঢাকার বাজারেও দাম বাড়তি।

তিনি বলেন, বর্তমানে বাজারে কোনো আমদানি করা পেঁয়াজ নেই। দেশি পেঁয়াজ দিয়েই চাহিদা মেটানো হচ্ছে। শুনেছি আমদানি বন্ধ আছে। আমদানি চালু না হওয়া পর্যন্ত পেঁয়াজের দাম আর কমবে না। এই সুযোগে কৃষকেরা কিছুটা দাম বাড়াতে পেরেছেন।

সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গত সপ্তাহে খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ছিল ৩০ থেকে ৫০ টাকা। চলতি সপ্তাহে এই দাম বেড়ে ৪৫ থেকে ৬৫ টাকা হয়েছে। টিসিবির হিসাবেও কেজিতে দাম বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ টাকা। গত বছরের এই সময়ে পেঁয়াজের দাম ছিল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা।

এদিকে, পেঁয়াজের বর্তমান খুচরা মূল্যকে যৌক্তিক বললেও দাম বৃদ্ধি যেন লাগামহীন হয়ে না পড়ে, সেদিকে নজরদারির পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের। এ বিষয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, ভোক্তা পর্যায়ে প্রতিকেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৬৫ টাকায়। এটি স্বাভাবিক পর্যায়েই রয়েছে। তবে দাম যেন এর থেকে বেশি না বাড়ে, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। একইসঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ে সংরক্ষণ প্রক্রিয়ায় ত্রুটি থাকলে দিন শেষে পেঁয়াজের সরবরাহ সংকটে পড়তে পারে বাজার, সেদিকে সজাগ থাকারও তাগিদ দিয়েছেন তিনি।

কৃষি বিভাগ বলছে, দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ৩২ থেকে ৩৫ লাখ মেট্রিক টন। গত অর্থবছরে ৩৬ লাখ মেট্রিক টন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ৩৪ লাখ টনের বেশি। ৩৮ লাখ ২১ হাজার টন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এবার। কোনো রকম ফলন বিপর্যয় ছাড়াই কৃষকের ঘরে উঠে গেছে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023 EU BANGLA NEWS