উপসচিব পদে পদোন্নতি ও সংস্কার নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের কঠোর সমালোচনা ও তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন প্রশাসন ক্যাডারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা। তারা সংস্কার কমিশন পুনর্গঠন ও কমিশনের চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবি করেছেন।
‘জনপ্রশাসন সংস্কারকে ভিন্নপথে পরিচালিত করে দেশকে অস্থিতিশীল করার গভীর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের অবসরপ্রাপ্ত এবং কর্মরত কর্মকর্তাদের যৌথ প্রতিবাদ’ সভায় কড়া বার্তা ও দাবির পক্ষে বক্তব্য দেন বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তারা।
বুধবার (২৫ ডিসেম্বর) বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর ইস্কাটনে বিয়াম ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে শুরু হয়ে চলে প্রায় চার ঘণ্টা। বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড এবং বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন (বাসা) যৌথভাবে এ সভার আয়োজন করে। এতে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ড. মো. আনোয়ার উল্ল্যাহ্। এতে সরাসরি অংশ নেন প্রায় শতাধিক কর্মকর্তা। আর অনলাইনে যুক্ত ছিলেন বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, ইউএনওসহ অন্যান্যরা। বক্তারা বলেন, দেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে। কমিশনগুলোর মাধ্যমে কালক্ষেপণের কায়দা-কানুন হচ্ছে। প্রশাসন ক্যাডারকে পঙ্গু করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। প্রশাসন নিয়ে ছেলে খেলা করা যায় না। নিরপেক্ষ জনপ্রশাসন বিনির্মাণে ‘বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস’ প্রতিষ্ঠা, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন পুনর্গঠন এবং কমিশনের চেয়ারম্যান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীর পদত্যাগ চান।
বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ড. মো. আনোয়ার উল্ল্যাহ্ বলেন, আমরা প্রশাসক ক্যাডারের ওপর কোনো রকমের সার্জারি বা কোটা আরোপ করতে দেব না। কমিশন কোনো অযাচিত সুপারিশ করলে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে। প্রশাসনের কোনো পর্যায়ে অন্ধভাবে বহিরাগত কাউকে এনে বসানোর চেষ্টা করা হলে তা কঠোরভাবে প্রতিহত করা হবে। পদোন্নতি ও পদায়নের ক্ষেত্রে বঞ্চিত কর্মকর্তাসহ সকল ধরনের কর্মকর্তাদের সম্মানজনক অবস্থান তৈরি করে জনপ্রশাসনকে অবিলম্বে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দেশকে কোনোভাবে অস্থিতিশীল করার জন্য যেকোনো ধরণের ষড়যন্ত্র মোকাবিলার জন্য প্রশাসন সারা দেশে সতর্ক থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমি ম্যাসেজ দিতে চাই- যেখানে সরকার আছে, আমাদের সাংবাদিক ভাইরা আছে, কর্মকর্তারা আছে, বিভিন্ন ধরনের সংস্কার কমিশন কাজ করছে- আমি ছয়টি ম্যাসেজ উপস্থাপন করে জানিয়ে দিলাম। বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি ১৯৮২ ব্যাচের এ বি এম আবদুস সাত্তার বলেন, আমার মনে হল আজকের এই প্রতিবাদ, এটা অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে কাজ শুরু করেছে। এই ষড়যন্ত্রকে ঠেকানোর জন্য দুটি বিষ দাঁত অঙ্কুরিত হয়েছে। এই বিষ দাঁতগুলো উপড়ে ফেলতে হবে। একটা হলো মুয়ীদ ভাই। বিষ মুয়ীদ। আমাদের নবীন কর্মকর্তারা হয়তো তাকে জানেন না। কিন্তু আমরা জানি। উনি ব্যক্তিগতভাবে, পারিবারিকভাবে একটা কলঙ্কিত ব্যক্তি। আমরা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মুয়ীদ ভাইয়ের অপসারণ চাই। সরকার যদি অপসারণ না করে কীভাবে অপসারণ করতে হবে সেই টুলস আমাদের জানা আছে। আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, আমি একটা আগাম প্রস্তাব দিয়ে রাখি। আগামী ৪ জানুয়ারি আপনারা যদি সম্মতি দেন আমরা একটা মহাসমাবেশ করতে পারি। যেখানে ৫০০ পাওয়ারের অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হবে। তাহলে আমার মনে হয় আর অপারেশনের প্রয়োজন হবে না। উপস্থিত সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে তিনি আরও বলেন, আজকে আমাদের আন্দোলনটা শুরু। এই বিসিএস প্রশাসন পরিবারকে বাঁচানোর জন্য আমাদের আরও অনেক কষ্ট করতে হবে এবং আমাদের এ ধরনের আয়োজন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলতে পারে। আমরা অনশনের কর্মসূচিও ঘোষণা করতে পারি। অতএব ধৈর্য ধরতে হবে এবং কষ্ট করতে হবে।
বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সম্পাদক ও ১৯৮৫ ব্যাচের কর্মকর্তা মোহাম্মদ মসিউর রহমান বলেন, বৈষম্যের জন্য জুলাই বিপ্লব হয়েছে। সেই বিপ্লবের পর এ সংস্কার মানি না। কোটা মানি না, মানবো না। জনপ্রশাসনে সংস্কার হচ্ছে আমাদের হাত কাটা, পা কাটা, ডানা কাটা; কেটে পঙ্গু করে দেওয়া। কমিশনের প্রায় সদস্য বিতর্কিত। একজনের বিরুদ্ধে মামলা, একজন মুয়ীদ (কমিশনের চেয়ারম্যান) সাহেবের কাছের লোক। আমরা কমিশনের পদত্যাগ চাচ্ছি, রিপোর্ট আর দরকার নেই। ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ও বিসিএস ১৯৮৫ ব্যাচের এ এস এম সালেহ আহমেদ বলেন, প্রশাসন ক্যাডারকে পিছিয়ে দেওয়ার জন্য, একটা সংকটে ফেলার জন্য চেষ্টা চলছে বলে মনে হচ্ছে। এর রকম সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট বহু আগে দেওয়া হয়েছে। সেটা আস্তাকুড়ে পড়ে থাকবে। বাস্তবায়ন হবে না। ঢাকা অফিসার্স ক্লাবের কোষাধ্যক্ষ ও বিসিএস ১৯৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তা এমএ খালেক বলেন, ৫ আগস্টের পর যাদের মনোবল ভেঙে গেছে এই কমিশনের উচিত ছিল তাদের মনোবল ফেরানো প্রথম কাজ। কিন্তু তারা সেটা করেনি। আমি এই কমিশনের প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করছি। ঢাকা জেলা প্রশাসক তানভীর আহমেদ বলেন, শক্তিশালী প্রশাসন ক্যাডার না থাকলে কাজ করা কঠিন, তার উদাহরণ আন্দোলনের পর সরকারের কাঠামোকে কে সামলে রেখেছে? এই প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাই সামলে রেখেছেন। এই মুহূর্তে আমাদের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, আমি আশা করছিলাম আপনারা ভালো কিছু করতে পারবেন। প্রশাসন রাজনীতি মুক্ত থাকবে সেটা নিয়ে কিছু বলছেন না, রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে সুরক্ষায় থাকতে হবে। এই কমিটিকে ঘরে ফিরে যাওয়া উচিত। কমিশনগুলোর মাধ্যমে কালক্ষেপণের কায়দা-কানুন হচ্ছে। বিসিএস ১৯৮৬ ব্যাচের কর্মকর্তা শামীম আল মামুন বলেন, পৃথিবীর কোথাও প্রশাসনকে নিয়ে নাড়াচাড়া হয় না, নাড়াচাড়া করাও উচিত না। কারণ এগুলো অনেক আগেই সেটেল হয়ে গেছে। প্রশাসন নিয়ে ছেলে খেলা করা যায় না। আমাদের অস্তিত্বে হাত দেওয়া মানে রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে দুর্বল করা। সংস্কার কমিশনকে পুনর্গঠন দরকার। আমরা তো বুড়ো হয়ে গেছি, তরুণ কর্মকর্তাদের পথ কণ্টকাকীর্ণ করতে তাদের প্রতিনিধি থাকা দরকার। আমি বিশ্বাস করি ভয়ের কিছু নেই, সংস্কার-টংস্কার কিছু হবে না। মুয়ীদ চৌধুরীকে উদ্দেশ্য করে বিসিএস ১৯৮৬ ব্যাচের কর্মকর্তা মো. জাকির হোসেন কামাল বলেন, আপনি তো পরীক্ষা দেননি, তাহলে আপনি কেন পরীক্ষা চাপিয়ে দিচ্ছেন। আমি আপনার পদত্যাগ দাবি করছে। সংস্কার কমিশন পূর্ণগঠন করতে হবে। শতভাগ কোটা আমাদের থাকতে হবে। বিসিএস ১৯৭৩ ব্যাচের মাহমুদ হোসেন আলমগীর বলেন, ক্যাডারে ঢোকার সময়ই ক্যাডার নির্ধারিত হয়। সেখানেই তার মাইন্ড সেট-আপ হয়। প্রশাসন ক্যাডারদের নিয়ে অনেক নাড়াচাড়া হয়েছে, আর নাড়াচাড়া না করার জন্য অনুরোধ করবো।
বিসিএস ২৮ ব্যাচের কর্মকর্তা মুশফিকুর রহমান বলেন, অনেক আগেই সুপ্রিম কোর্ট যেটা সেটেল করে দিয়েছে সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলা মানে ষড়যন্ত্র। আমরা এ ব্যাপারে কোনো কম্প্রোমাইজ করবো না। বিসিএস ২৯ ব্যাচের সাইফুল কবীর বলেন, আমরা মনে করছি রাষ্ট্রকে অকার্যকর করার চেষ্টা চরছে। গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। আমরা চাই অন্য ক্যাডারের জন্য ২৫ শতাংশও যেন না থাকে। বিসিএসের ফলাফলের সময় যেন প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় চয়েজ উল্লেখ করা হয়। প্রশাসন ক্যাডার ছয় হাজার ৮ জনের একটি সার্ভিস ক্যাডার উল্লেখ করে এই ক্যাডারের কর্মকর্তা সামিউল মাসুদ বলেন, কোটার বিষয়টিকে নিয়ে কমিশন দুই পক্ষকে মুখোমুখি করে আগুন জ্বালিয়ে দিলেন। কী করণে, কার ইন্ধনে করলেন, এই দোষ দিতে হলে কমিশনকেই দিতে হবে। সুপারিশ চূড়ান্ত করার আগে সেনসিটিভ বিষয়টি নিয়ে কেন মিডিয়ায় কথা বললেন? বিসিএস ১৯৭৯ ব্যাচের এসএম জহুরুল ইসলাম বলেন, সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট অতীতের মতো দুমড়ে-মুচড়ে যাবে। আমরা তাদের উদ্দেশ্য বুঝে গেছি। এ বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব সোহেল রানা বলেন, ৫০ শতাংশ কোটা করার সুপারিশ বৈষম্যমূলক, অযৌক্তিক ও ষড়যন্ত্রমূলক। কেন আমাদের ফ্যাসিস্ট বলা হচ্ছে, আমরা ছাড়া অন্য ক্যাডারের কেউ নির্বাচনগুলোর দায়িত্ব পালন করেনি? আমরা অন্য ক্যাডারগুলোর প্রতিযোগী নই। আমরা একসাথে কাজ করতে চাই। ১৯৯১ সালে যে ২৫ শতাংশ কোটা দখল করা হয়েছে, ইসরায়েলের মতো আমরা এখন আর বাকি কোটা দখল হতে দেব না। এই সংস্কারের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে দুর্বল করার কোনো ষড়যন্ত্র চলছে কিনা তা মাথায় রেখে আমাদের সজাগ থাকতে হবে।
প্রতিবাদ সভায় যুগান্তরের উপ-সম্পাদক বিএম জাহাঙ্গীর, নবম ব্যাচের কর্মকর্তা হাফিজুর রহমান, নুরুল করীম ভূইয়া, ১৯৮১ ব্যাচের কর্মকর্তা হেলালুজ্জামান, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার একান্ত সচিব মো. সারওয়ার আলম, ঢাকা জেলার এডিসি বদরুদ্দোজা শুভ, ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ কিরণ বক্তব্য দেন।