সারাবছর খোলা আকাশের নিচে রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয়েছে বাংলাদেশ কৃষি করপোরেশনের (বিএডিসি) আমদানিকৃত লাখ লাখ বস্তা নন-ইউরিয়া সার। আসন্ন বোরো মৌসুম সামনে রেখে ওই সার শুকিয়ে ক্রাশিং করে ফের নতুন বস্তায় ভরে বিএডিসি গুদামে পাঠাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট পরিবহন ঠিকাদাররা।অপেক্ষাকৃত গুণাগুন নষ্ট হওয়া ওই সার কিনে কৃষক প্রতারিত হতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবু কৃষির গুরুত্বপূর্ণ এই খাতে দায়িত্বরতদের বছরের পর বছর উদাসীনতা কাটছে না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বছরজুড়েই যশোরের শিল্পনগরী নওয়াপাড়া, খুলনা ৭নং ঘাট, মুক্তারপুর, আশুগঞ্জ ঘাটে খোলা আকাশের নিচে নামমাত্র তাঁবু টাঙিয়ে এসব সার রাখতে দেখা যায়। গত বছর ডলার সংকটের মধ্যেও বিদেশ থেকে উচ্চমূল্যে আমদানি করা সার এখনো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে খোলা আকাশের নিচে রোদ-বৃষ্টিতে পড়ে রয়েছে। বিশেষ করে মুক্তারপুরের আমান ঘাটে এখনো প্রায় ৮০ হাজার থেকে এক লাখ বস্তা ডিএপি সার পানিতে ভিজে-গলে মানহীন অবস্থায় পড়ে রয়েছে। যার আমদানি মূল্য ৬০ থেকে ৭০ কোটি টাকা। দেশে ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে সরকার ওই সারে বিপুল অর্থ ভর্তুকি গুনছে। কিন্তু বিএডিসি কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের গাফিলতিতে ভালো সার নিম্নমানে নেমেছে, যা কৃষকদের ক্ষতিগ্রস্ত করার ঝুঁকি তৈরি করেছে।
একাধিক ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ভেজা সারের বস্তা শ্রমিকরা রোদে দিয়ে শুকাচ্ছেন। আর যেসব বস্তা পুরোপুরি ভিজে সার নরম হয়ে গেছে সেসব বস্তা থেকে সার ঢেলে শুকিয়ে দলা বাঁধিয়ে তারপর আবার ক্রাশিং করে নতুন বস্তায় রি-প্যাকিং করা হচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নতুন সারও মেশানো হচ্ছে। এরপর আশপাশের বিএডিসি গুদামে সরবরাহ করা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএডিসির আমদানি করা ওই সারের শিপ ব্রোকার ও পরিবহন ঠিকাদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে ‘মেসার্স বঙ্গ ট্রেডার্স’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। কয়েক মাস আগে সার ভিজে যাওয়ার ঘটনা সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন বিএডিসির জিএম আজিম উদ্দিন, ম্যানেজার মেজবাহ উদ্দিন, মুভমেন্ট ম্যানেজার নোমান উদ্দিন, যুগ্ম-পরিচালক কামাল উদ্দিন।
প্রাথমিকভাবে সার পরিবহন ঠিকাদারের দায়িত্বহীনতার কারণে সরকারের বিপুল ক্ষতি হলেও শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। গুঞ্জন রয়েছে, সংস্থাটির শীর্ষপদের এক কর্মকর্তা ও তৎকালীন সদস্য পরিচালক (সার) আব্দুস সামাদের হস্তক্ষেপে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। এমনকি ঊর্ধ্বতনদের ইশারায় বিএডিসির দায়িত্বপ্রাপ্ত ট্যাগ অফিসার ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিশেষ কারণে মানহীন সার গুদামে ঢোকাতে বিধিনিষেধ দিতে পারেননি।
সরকারি আইন অনুযায়ী, সার সুষ্ঠুভাবে গুদামে পৌঁছে দিতে না পারলে সংশ্লিষ্ট পরিবহন ঠিকাদারের কাছ থেকে আমদানিমূল্য আদায় করার বিধান রয়েছে। তবে এসব ঘটনায় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান বিএডিসি কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ ফর্মুলায় তুষ্ট রেখে নষ্ট সার গুদামে পৌঁছে দিয়ে কৃষকদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
কয়েকটি জেলায় বিগত কয়েক মাসের বরাদ্দের বিপরীতে গুদাম থেকে মানহীন সার ডিলারদের সরবরাহ করলে কৃষক পর্যায়ে অসন্তোষ দেখা দেয়। কৃষক ও ডিলাররা এই সারের গুণাগুণ নিয়ে প্রশ্ন তুললেও পাননি প্রতিকার। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই সার বিএডিসির মেড্ডা গোডাউন থেকে সরবরাহ করা হয়েছে। স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারাও এমন অভিযোগ পেয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন।
যশোরের কেশবপুর উপজেলার কোমরপোল গ্রামের কৃষক দাউদ খাঁ বাংলানিউজকে বলেন, প্রতি মৌসুমে যখনই সারের প্রয়োজন হয় ঠিক সেই মুহূর্তে স্থানীয় ডিলার পয়েন্টে চাহিদা মোতাবেক সার সরবরাহ থাকে না। গেল মৌসুমে বস্তায় ২০০ টাকা বেশি দিয়ে সার কিনতে বাধ্য হয়েছে। তারপরও প্রচুর চাহিদার ওই সময়ে ভেজা ও জমাটবাঁধা সার কিনতে বাধ্য হতে হয়।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় আরেকজন কৃষক মশিয়ার রহমান বলেন, সারের ত্রুটি ধরতে গেলে স্থানীয় ডিলার মালিকরা বলে থাকেন- গুদাম থেকে যা পেয়েছি তাই বিক্রি করছি। পছন্দ হলে কেনেন, না হলে রেখে যান। এতে বাধ্য হয়েই জমাটবাঁধা সার কিনতে বাধ্য হই। এ ধরনের সার ব্যবহার করে ঠিকমতো ফসলের হিসাবও মেলে না।
এদিকে, সারের গুণাগুণ নষ্টের জন্য বিএডিসিকে দায়ী করছেন কয়েকটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। তাদের মতে, সারাদেশের বিএডিসি গুদামগুলোর ধারণ ক্ষমতা দুই লাখ ৪০ হাজার থেকে দুই লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। অথচ প্রতিবছর বিএডিসি আমদানি করে ২০ থেকে ২২ লাখ মেট্রিক টন। ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত আমদানি করার কারণে সময়মতো সার পৌঁছে দিলেও গুদামে জায়গার অভাবে তারা বুঝে নিতে ব্যর্থ হয়। ফলে খোলা আকাশের নিচে তাঁবু টাঙিয়ে মজুদ রাখতে বাধ্য হয় ঠিকাদাররা।
যদিও বিএডিসির যোগসাজশে কিছু অদক্ষ ঠিকাদার পরিবহনের কাজ নিয়ে ওই সার কালোবাজারে বিক্রির মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ার নজির রয়েছে। গত বছর বঙ্গ ট্রেডার্স নামে একটি পরিবহন ঠিকাদারের কাছে থাকা প্রায় ২০ লাখ বস্তা ডিএপি সার ভিজে নষ্ট হয়। তুলনামূলক মানহীন ওই সার রোদে শুকিয়ে ভালো সারের সঙ্গে মিশিয়ে বিএডিসি গুদামে পাঠানোর অভিযোগ রয়েছে। এখনো বিপুল পরিমাণ নিম্নমানের সার গুদামে পাঠানো হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকারি সারের সাব-ডিলার শাহজাহান আলী ও আসাদুজ্জামান গাজী বাংলানিউজকে বলেন, সারাবছরই যে খারাপ সার আসে, ব্যাপারটা এমন নয়। মূলত যখন সারের প্রচুর চাহিদা থাকে, তখন কিছু এ ধরনের (ভেজা-জমাটবাঁধা) সার আসে, যেমন নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে অধিকাংশ ইউরিয়া, ডিএপি-এমওপি সার নিয়ে কৃষকরা অখুশি হয়েছেন। এখন আপাতত তুলনামূলক ভালো বস্তার সার আসছে।
যদিও স্থানীয় বিএডিসি সূত্র জানায়, গত মৌসুমে এ অঞ্চলে কমপক্ষে ১৫ হাজার ভেজা সার গোডাউন থেকে সরবরাহ করা হয়েছে।
শ্রীনগরের বিসিআইসি ডিলার মেসার্স আর কে এন্টারপ্রাইজের মালিক রেজাউল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘গত মৌসুমে স্থানীয় গোডাউনগুলো থেকে ভেজার কারণে শক্ত হয়ে যাওয়া নিম্নমানের ডিএপি সার সরবরাহ করা হয়। যার কারণে বরাদ্দের সব সার উত্তোলন করিনি। যা উত্তোলন করেছি তা কৃষক না কেনার কারণে স্থানীয় মৎস্য খামারিদের কাছে অল্প মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছি। ’
সার ভেজা প্রসঙ্গে বঙ্গ ট্রেডার্সের ম্যানেজার বাবুল দাস বাংলানিউজকে বলেন, এ ধরনের কোনো তথ্য আমার কাছে নেই।
তবে বিপুল পরিমাণ ভেজা সার শুকানো এবং ক্রাশিং করার ভিডিও ফুটেজ রয়েছে জানিয়ে দৃষ্টিআকর্ষণ করলে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে আমার কাছে তথ্য নেই, আমি ওখানে খোঁজ-খবর নেব।
বিএডিসি কর্মকর্তাদের পরিদর্শনের বিষয়টিও তিনি জানেন না বলে দাবি করেন।
এ বিষয়ে বিএডিসির জেনারেল ম্যানেজার (সার) আজিম উদ্দিনকে মোবাইল ফোনে কল করা হলে তিনি প্রতিবেদকের পরিচয় পেয়ে কল কেটে দেন।
পরে বিএডিসির ম্যানেজার মেজবাহ উদ্দিন ও যুগ্ম-পরিচালক কামাল উদ্দিনকে ফোনকল করা হলেও তারা রিসিভ করেননি।
আর বিএডিসি চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ সাজ্জাদের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলে সাড়া মেলেনি তারও।