জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন (এনআইডি) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে অধীনে নেওয়ার আইন বাতিল এবং এনআইডি নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অধীনেই রাখার দাবি জানিয়েছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা।
মঙ্গলবার (২৭ আগস্ট) তারা প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের কাছে এ সংক্রান্ত স্মারকলিপি দিয়েছেন।
এতে বলা হয়েছে, ছাত্র-জনতার সফল বিপ্লব ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে গত ০৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শাসনামলের পতনের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। ফলস্বরূপ অন্তর্বর্তী সরকার বৈষম্যহীন বাংলাদেশ বিনির্মাণে নবযাত্রা শুরু করেছে।
স্মারকলিপিতে বলা হয়, আপনি অবগত, ২০০৭-০৮ সালে দল-মত নির্বিশেষে সকলের আস্থার জায়গা থেকে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এবং বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সার্বিক সহযোগিতায় বাংলাদেশ সরকার ও ইউএনডিপিসহ নয়টি আন্তর্জাতিক দাতাসংস্থার আর্থিক সহায়তায় আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করে ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
এতে বলা হয়, আদালতের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রায় ৮ দশমিক ১০ কোটি নাগরিকের ডেমোগ্রাফিক ও বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহপূর্বক জাতীয়ভাবে ভোটার ডাটাবেজ গড়ে তোলা হয়। গত ২ মার্চ জাতীয় ভোটার দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত চূড়ান্ত ভোটার তালিকা অনুসারে এ ডাটাবেজে প্রায় ১২ দশমিক ১৯ কোটি নাগরিকের তথ্য রয়েছে।
এতে আরও বলা হয়, ইউএনডিপির সমীক্ষা অনুসারে, ভোটারদের এ সংগৃহীত ডাটা ৯৯ দশমিক ৭ শতাংশ সঠিক মর্মে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে ওই তথ্যের ভিত্তিতেই অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় ব্যতিরেকে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০১০ অনুসারে নির্বাচন কমিশনের একই জনবল দিয়ে গত ১৭ বছর ধরে নিবন্ধিত নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হচ্ছে। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় এ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য দেশব্যাপী নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব অবকাঠামো, এ কার্যক্রম পরিচালনায়
প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনবল তৈরি হয়েছে।
স্মারকলিপিতে বলা হয়, বিগত সরকার সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করে দুরভিসন্ধিমূলকভাবে নাগরিকদের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত ও গোপনীয় তথ্য যথেচ্ছ ব্যবহারের লক্ষ্যে রুলস অব বিজনেস সংশোধন করে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন সংক্রান্ত কার্যক্রম নির্বাচন কমিশনের পরিবর্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন ন্যস্তকরণের সিদ্ধান্ত নেয়।
জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০১০ বাতিলপূর্বক জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০২৩ প্রণয়ন করা হলেও বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের অধীনে এনআইডি কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এর পক্ষে ‘জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন সংক্রান্ত কার্যক্রম নির্বাহী বিভাগের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত’ এবং ‘বিভিন্ন দেশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উক্ত দায়িত্ব পালনে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ’ হিসেবে অপযুক্তি দেখানো হলেও প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর বহু দেশে নির্বাচন কমিশন, স্থানীয় সরকার, পুলিশ ও সংবিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষ এ দায়িত্ব পালন করে।
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনকে রোল মডেল হিসেবে বিবেচনা করে জ্যামাইকা, ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো, সেন্ট লুসিয়া ও সেন্ট ভিনসেন্ট অ্যান্ড গ্রানাডা দ্বীপপুঞ্জ ইত্যাদি দেশের নির্বাচন কমিশন সফলভাবে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
মূলত নির্বাচন ব্যবস্থাপনা তথা ভোটার তালিকা প্রণয়নে নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করার উদ্দেশ্যেই জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০২৩ প্রণয়ন করা হয়েছে মর্মে পরিগণিত হয়।
কারণ উক্ত আইনে ধারা ১৫ এ বর্ণিত আছে যে-
(১) নির্বাচন কমিশনের চাহিদা মোতাবেক নিবন্ধক প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত দেবে।
(২) উপ-ধারা (১) এর উদ্দেশ্য পূরণকল্পে নিবন্ধকের কার্যালয়ের অধীন একটি সেল থাকবে।
(৩) এ সেলে নির্বাচন কমিশনের এক বা একাধিক কর্মচারী দায়িত্ব পালন করবেন।
এর মাধ্যমে কৌশলে নির্বাচন কমিশনকে সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখাপেক্ষী করা হয়েছে, যা প্রকারান্তরে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতাকে খর্ব করে।
সিইসিকে কর্মকর্তারা স্মারকলিপিতে আরও বলেন, আপনি জানেন, ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও জাতীয় পরিচয়পত্র প্রস্তুত দুটি ভিন্নধর্মী কাজ হলেও একই অর্থ, সময় ও জনবল দিয়ে একদিকে ভোটার তালিকা প্রস্তুত অন্যদিকে নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ায় নির্বাচন কমিশনের যুগোপযোগী উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি বাস্তবায়ন ও ধারাবাহিকতা সর্বস্তরে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে।
এটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হলে অহেতুক বিতর্ক তৈরি করা হবে এবং নিম্নরূপ নানাবিধ সমস্যা সৃষ্টি হবে।
ক) আদালতের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন, আইনি জটিলতা ও ভোটার তালিকার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে;
খ) নাগরিকদের তথ্যের গোপনীয়তার সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হবে;
গ) নতুন অবকাঠামো স্থাপন ও জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারি বিপুল পরিমাণ অর্থের অপচয় হবে;
ঘ) তথ্যভান্ডারের শুদ্ধতা বিনষ্ট হবে,
ঙ) তথ্যের নিরাপত্তা হুমকি দেখা দেবে;
চ) প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনের অস্তিত্বের সংকট দেখা দেবে;
ছ) নির্বাচন পরিচালনায় বিঘ্ন সৃষ্টি হবে;
জ) প্রযুক্তিনির্ভর ভোটগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হবে;
ঝ) আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হওয়ার শঙ্কা দেখা দেবে;
ঞ) সরকারি/বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া এনআইডি যাচাই সেবা বিঘ্নিত হবে।
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে নির্বাচন কমিশনের অধীনে নাগরিকগণের তথ্য সংরক্ষিত থাকায় কোনো তথ্য বিকৃতিসহ তথ্যের অপব্যবহারের সুযোগ কম। বর্তমানে সুরক্ষা সেবা বিভাগের অধীনে বাংলাদেশি নাগরিকদের পাসপোর্ট সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
একই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এনআইডি কার্যক্রম পরিচালনা করা হলে ডাটাবেজ ম্যানুপুলেট করার শঙ্কা দেখা দেবে এবং বিদ্যমান চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স বিনষ্ট হবে।
স্মারকলিপিতে আরও বলা হয়েছে, স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে নাগরিকদের নিয়ে যেসব ডাটাবেজ তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে একমাত্র ভোটার তথা এনআইডি ডাটাবেজ ছাড়া অন্য কোনো ডাটাবেজ শতভাগ আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এ কারণে বাংলাদেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান নাগরিকদের পরিচিতি নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রস্তুতকৃত ডাটাবেজ ও নাগরিক সেবার ওপর আস্থাশীল, যা নির্বাচন কমিশনের এক অনন্য অর্জন।
জাতীয় স্বার্থে অমূল্য এ তথ্যভান্ডারকে সুসংহত রেখে অব্যাহত নাগরিক সেবা নিশ্চিতকল্পে নির্বাচন কমিশন হতে জাতীয় পরিচয়পত্র কার্যক্রম সুরক্ষা সেবা বিভাগে ন্যস্তকরণের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০২৩ বাতিল সংক্রান্ত অধ্যাদেশ জারির কার্যকর উদ্যোগ নিতে বিনীত অনুরোধ জানান কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের ব্যানারে কর্মকর্তারা এ স্মারকলিপি জমা দেন। এতে সই করেন সংগঠনের মহাসচিব মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান।