ব্যাংক খাতে অস্থিরতা, শঙ্কায় আমানতকারীরা

ব্যাংক খাতে অস্থিরতা, শঙ্কায় আমানতকারীরা

সংকটে থাকা দেশের ব্যাংক খাতে নতুন অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। সরকার পতনের পর ব্যাংকে ব্যাংকে আন্দোলন-বিক্ষোভ গোলাগুলিতে গড়িয়েছে।ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তনসহ বিভিন্ন দাবিতে চলমান এই আন্দোলন নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন আমানতকারীরা। অনেক সঞ্চয়কারী শঙ্কায় ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ঝুঁকিতে এটিএম বুথে টাকা না পাওয়া, নগদ টাকা উত্তোলনের সীমা দুই লাখ টাকা বেধে দেওয়ায় দৈনন্দিন পরিচালন ব্যয় মেটাতে বিপাকে পড়েছে ব্যবসায়ীরা। পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি না হলে সংকট বাড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

মালিকানা পরিবর্তনের দাবিতে ব্যাংকে ব্যাংকে মানববন্ধন

সরকার পতনের পর থেকেই মালিকানা বদল ও পদবঞ্চিতদের দাবি আদায়ে আন্দোলন শুরু হয়েছে ব্যাংকে ব্যাংকে। ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দুই গ্র“পের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। রবিবার ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ের সামনে এই ঘটনায় অন্তত ছয় জন গুলিবিদ্ধ হন। সরকার পতনের পর থেকে ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারা ব্যাংকটির পর্ষদ পুনর্গঠনের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ‘লুটেরাদের’ বের করে  দেওয়ার দাবি জানান।  

গতকাল সোমবারও প্রধান কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছে ব্যাংকটির পুরোনো কর্মীরা। ফলে ব্যাংকটিতে ২০১৭ সালের পর নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারা কেউ প্রবেশ করতে পারেননি। পাশাপাশি তাঁরা রবিবারের গুলির ঘটনার বিচার দাবি করেছেন।  

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে মহড়া দিয়েছে একদল অস্ত্রধারী লোক। এতে তাঁরা আতঙ্কে সময় পার করছেন কর্মী ও ব্যাংকের গ্রাহকরা। আইএফআইসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান ও তাঁর ছেলেসহ বেক্সিমকোর সব পরিচালকের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন ব্যাংকটির বর্তমান ও চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।  

ইউসিবির বর্তমান পর্ষদের বিরুদ্ধেও মানববন্ধন করে শেয়ারহোল্ডারদের একটি অংশ। বেসরকারি খাতের আইএফআইসি, ওয়ান, বাংলাদেশ কমার্সসহ কয়েকটি ব্যাংকে বিক্ষোভ হয়। সুযোগ-সুবিধা ও দাবিতে রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকেও বিক্ষোভ হয়েছে।  
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকের মতো একটি স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠানে আন্দোলন-গোলাগুলি কোনোভাবেই কাম্য নয়। যৌক্তিক দাবি-দাওয়া ব্যাংকের প্রচলিত নিয়ম মেনে দ্রুত সমাধান করা উচিত। না হলে আমানতকারীরা ব্যাংকের প্রতি আস্থা হারালে সংকট আরো দীর্ঘায়িত হবে।  

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ বলেন, ‘ব্যাংকে বিক্ষোভ-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। গত কয়েক বছরে কোনো কোন ব্যাংকের একটি পক্ষ অন্য সব ব্যাংকের শেয়ার হোল্ডারদের কোণঠাসা করে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছিলো। সেটার কারণে অনেক অনিয়মও হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা যেখানে হয়েছে সেসব জায়গায় বিক্ষোভ হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে বিক্ষোভ ব্যাংকের দরজায় না করে আলোচনার টেবিলে হওয়া উচিত। সেটা হতে হবে একটা নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। কর্মীদের অভিযোগ জানানোর একটা সঠিক প্ল্যাটফর্ম দিতে হবে। যারা বিক্ষোভ করছে, ক্ষোভ প্রকাশ করছে তাদের হয়তো ইস্যুগুলো যৌক্তিক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নেতৃত্বেও এই আলোচনাগুলো শুরু করে ব্যবস্থাপনা  ও পর্ষদে পরিবর্তন আসা দরকার। ’

মাশরুর রিয়াজ বলেন, গণ অভ্যুত্থান পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়েও কারও কারও শঙ্কা বাড়ছে অহেতুকভাবে। সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে এবং সেটা দ্রুত করতে হবে। ঢালাওভাবে ব্যাংক থেকে টাকা উঠানোর পরিমাণ দুই লাখ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না। এতে ট্রানজাকশনের ক্ষতি হবে। ধীরে ধীরে এটাকেও বাড়িয়ে একটু যৌক্তিক জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। ব্যাংকে এসব বিশৃঙ্খলা যদি এভাবে খোলা ময়দানে চলে, তাহলে বিদেশি স্টেক হোল্ডারদের মধ্যেও আস্থার সংকট দেখা দিতে পারে।  

গবেষণা সংস্থা পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করছেন, গত কয়েক দিনে বিভিন্ন ব্যাংকে মালিকানা নিয়ে বিক্ষোভ, আন্দোলন, নিয়ন্ত্রণ নেওয়াসহ যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, জরুরি ভিত্তিতে সেখানে হস্তক্ষেপ করতে হবে। এই মুহূর্তে ব্যাংক থেকে যাতে কেউ টাকা নিয়ে চলে যেতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে।

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, পুরো ব্যাংক খাত একসঙ্গে সংস্কার করা যাবে না। কিছু কাজ করতে সময় লাগবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রশাসনিক কাঠামো দ্রুত পুনর্গঠন করতে হবে।

ব্যাংকের বাইরে দুই লাখ ৬১ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা

এদিকে ব্যাংক খাতের অস্থিরতায় মানুষের হাতে নগদ অর্থের পরিমাণ বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতের বাইরে বা মানুষের হাতে নগদ অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৬১ হাজার ১৯৫ কোটি টাকায়। কিন্তু এক মাস আগেও এর পরিমাণ ছিল দুই লাখ ৫৭ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা, ২০২৩ সালের মার্চে যা ছিল দুই লাখ ৫৪ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা।  
ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণ আমানতকারীরা ব্যাংক থেকে টাকা তুললেও ব্যাংকে নতুন করে তেমন জমা দিচ্ছে না। এতে ক্রমে বাড়ছে ব্যাংকবহির্ভূত টাকার পরিমাণ। অন্যদিকে আমানত প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক চিত্র দেখা যাচ্ছে।  

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মে মাস শেষে দেশের ব্যাংক খাতের মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৬০৮ কোটি টাকা। কিন্তু এক মাস আগে এর পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ৮১ হাজার ৯৩৯ কোটি। অর্থাৎ আমানত প্রবৃদ্ধির হার এক মাসে ১.১ শতাংশ। এখন আমানতের সুদের হার ৯ শতাংশের উপরে। নতুন করে আমানত না আসলেও ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হওয়ার কথা। সেখানে আমানতে ১.১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আসলে প্রবৃদ্ধি নয় অবনতি।
বেসরকারি ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, ‘উচ্চ মাত্রার খেলাপিঋণসহ আরো যেসব কারণে ব্যাংকের স্বাস্থ্য খারাপ হয় সেসব কারণ না করে তাহলে আমানতকারীদের ভয়ের কারণ নেই। ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অর্থ ধার করে চলছে। তাদের মধ্যে যদি কারো অবস্থা বেশি খারাপ হয় তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংককে এখনই চিন্তা করতে হবে কীভাবে আমানতকারীদের সুরক্ষা দেওয়া যায়। আমানতকারীদের আস্থা একবার নষ্ট হয়ে গেলে তা ফিরিয়ে আনতে অনেক সময় লাগবে। ’
ব্যাংক খাতে যে সংকট তৈরি হয়েছে তা নিরসনে আর দেরি করা উচিত হবে না বলে মনে করেন এই ব্যাংকার। মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, ‘যে ব্যাংকগুলোতে সংকট চলছে সেগুলো শুরুর সময় ভালো প্রতিষ্ঠান ছিল। মালিকানা বদলের পর এগুলোকে খারাপ করা হয়েছে। এখানে পরিবর্তন আনতে হলে ম্যানেজমেন্ট পরিবর্তন আনতে হবে। বোর্ডের কাঠামোও পরিবর্তন করতে হবে। যদি কোন ব্যাংকে বোর্ড পরিবর্তন করা না যায় তাহলে কার্যপরিধি সীমিত করতে হবে। গোলাগুলির কারণ বের করে সঙ্গে সঙ্গে থামানোর ব্যবস্থা নিতে হবে, বিতর্কিতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। সুশাসনের অভাব, খেলাপি ঋণের মতো অন্য যে সমস্যাগুলো আছে সেগুলো ধাপে ধাপে সমাধান করতে হবে। ’

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, এত দিন বিশেষ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর প্রসারে কাজ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক দশকের বেশি সময় ব্যাংক খাতে ২৪টি বড় ধরনের কেলেঙ্কারি হয়েছে। এসব কেলেঙ্কারির পরিমাণ ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। তিনি বলেন, আমানতকারীদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। কিন্তু যাঁদের কারণে ব্যাংকিং খাতে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, তাঁরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।  

নগদ টাকার সংকটে ব্যবসায়ীরা
নগদ টাকার অভাবে দেশের ব্যবসায়ীরা এক ধরনের সংকটে পড়েছেন। ব্যাংক থেকে দৈনিক নগদ টাকা তোলার সীমা বেঁধে দিয়েছে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত শনিবার ব্যাংকগুলোকে বলা হয়, প্রতিটি অ্যাকাউন্ট থেকে দৈনিক দুই লাখ টাকার বেশি তোলা যাবে না। এই পরিমাণ বাড়ানোর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত বৃহস্পতিবার দৈনিক নগদ এক লাখ টাকা তোলায় সীমিত করেছিল।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, যদি নগদ টাকার সংকট বাড়তে থাকে এবং আগামী সপ্তাহেও বিধিনিষেধ চলতে থাকে তবে তারা আরও কঠিন পরিস্থিতিতে পড়বেন।
বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় খুব সমস্যায় পড়েছি আমরা। কারণ মাত্র দুই লাখ টাকা দিয়ে তো একটি কম্পানির বেতন দেওয়া যায় না। তাই আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করে বেতনের টাকা দেওয়ার জন্য দুই লাখ টাকার বেশি উত্তোলনের অনুমতি নিয়েছি। ব্যাংক থেকে টাকা তুলে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান জুলাই মাসের বেতন দিতে সক্ষম হয়েছে। তবে পুরো সমস্যা এখনো সমাধান হয়নি। ’
ব্যাংক থেকে টাকা তোলার ক্ষেত্রে সীমা আরোপ করা হয়েছে (দুই লাখ) এবং সেই সঙ্গে এটিএম বুথে টাকা পাওয়া যাচ্ছে না। এর ফলে মানুষ বিপাকে পড়েছে। এই পরিস্থিতি কত দিন চলবেÑসাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, টাকা নেই, তা নয়। এটা করা হয়েছে নিরাপত্তাহীনতার কারণে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকাররা প্রতিদিন বড় ট্রাংকে করে টাকা নিয়ে যান। কিন্তু এখন রাস্তা দিয়ে সেই টাকা পরিবহন করা বিপজ্জনক। এটিএম বুথেও হামলা হয়েছে, সে জন্য শঙ্কা ছিল। অর্থসচিব বিষয়টি দ্রুততার সঙ্গে দেখবেন।  
ইসলামী ব্যাংকের দখল নিয়ে সংঘাত ও গোলাগুলিতে যারা জড়িত, তাদের শিগগির আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘কেউ আইনের বাইরে নয়। জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমি নিজেও এককালে ম্যাজিস্ট্রেট ছিলাম। এসব ধরপাকড় কম করিনি। ’

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023 EU BANGLA NEWS