শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সংঘাতময় এ পরিস্থিতির শুরুর দিকে পুলিশের গুলিতে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের নিহত হওয়ার ছবি ও ভিডিও অনেকে দেখেছেন। এরপর দেশজুড়ে ব্যাপক সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুর, গুলি, অগ্নিসংযোগ ও প্রাণহানি, ইন্টারনেট বন্ধ, দেশে কারফিউ জারি, সেনাবাহিনী মোতায়েন, দফায় দফায় এইচএসসি পরীক্ষা পেছানো—এসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে মানুষকে। অনাকাঙ্ক্ষিত এসব ঘটনা সরাসরি ভুক্তভোগীদের পাশাপাশি পরোক্ষ ভুক্তভোগীদেরও মনের ওপর চাপ ফেলছে। এগুলো অনেকের ওপর দীর্ঘ মেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিশু-কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ। মনের ওপর এই চাপ সামলাতে কী করা যায়, তা নিয়ে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিবেদক মানসুরা হোসাইনের সঙ্গে কথা বলেছেন ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ।
গত ৫ জুন থেকে শুরু হওয়া আন্দোলনে মানুষের জীবনযাত্রা থমকে গেছে। এ পর্যন্ত ২০০ জনের বেশি মানুষের প্রাণহানিসহ যে ঘটনাগুলো ঘটছে, তা মানুষের মনে কেমন প্রভাব ফেলতে পারে?
ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ: বলা যায়, সহিংসতার কয়েক দিনে দেশে একধরনের যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করেছে। এত মানুষের প্রাণহানির ঘটনা দেখতে হয়েছে মানুষকে। এসব ঘটনায় সরাসরি ভুক্তভোগী ব্যক্তি, পরিবার, সংবাদকর্মী, চিকিৎসক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মনে চাপ তৈরি হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, যে মানুষ ঘরে বসে টেলিভিশনে ঘটনাগুলো দেখছেন বা শুনছেন, তাঁদের মনেও চাপ পড়ছে। যদি নিজের বেলায় এ ঘটনা ঘটত বা পরিবারের কোনো সদস্যের হতো, তখন কী হতো, সে চিন্তায় মানুষ অস্থির হয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ এ চাপ কাটিয়ে উঠতে পারলেও অনেকেই চাপ মোকাবিলা করতে পারছেন না বা পারবেন না। তাঁদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি মানসিক সমস্যা দেখা দেবে।
দীর্ঘমেয়াদি মানসিক সমস্যার বিষয়টি যদি একটু সহজ করে বলতেন।
ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ: কোনো অস্বাভাবিক, অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে মানুষ প্রাথমিক পর্যায়ে তীব্র মানসিক চাপে ভুগতে থাকেন। পরবর্তী সময়ে পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (পিটিএসডি) দেখা দিতে পারে। পিটিএসডি একটি মানসিক ও আচরণগত সমস্যা, যা যৌন নিপীড়ন, যুদ্ধ, সংঘর্ষ, শিশু নির্যাতন, পারিবারিক সহিংসতা বা যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অভিজ্ঞতার শিকার হওয়া মানুষের হতে পারে। এতে আক্রান্ত হলে মানুষ যেন বারবার ওই ঘটনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, এমন অনুভব করেন, আবার ঘটতে যাচ্ছে, এ রকম আতঙ্ক বোধ করেন।
পিটিএসডি বা আঘাত–পরবর্তী মানসিক চাপের ক্ষেত্রে সাধারণত কোন বৈশিষ্ট্যগুলো দেখা দেয়?
ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ: অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সম্মুখীন হলে মানুষের মধ্যে স্মৃতি ফিরে আসে। ভীতি কাজ করে। অনেকে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। কারও কারও মাথা ঘুরতে থাকে, বমিসহ শারীরিক নানা জটিলতা দেখা দেয়। পরবর্তী কোনো দুর্ঘটনায় তখন আর আবেগ কাজ করে না। ঘুমের তীব্র সমস্যা দেখা দেয়। অনেকে নিজেকে গুটিয়ে ফেলে। সামাজিক দক্ষতা কমে যায়।
শিশু-কিশোরদের বেলায় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার প্রভাব কতটুকু পড়ে?
ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ: বড়দের চেয়ে শিশু-কিশোরদের বেলায় এমন পরিস্থিতির প্রভাব বেশি হয়। দেশে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় হুট করে শিশু-কিশোরদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। পরীক্ষা পিছিয়ে গেছে। এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের কেউ কেউ শিশু-কিশোরদের বন্ধু বা পরিচিতজন। পরিচিত না হলেও নিজের বয়সী বা আরও ছোট শিশুদের মারা যাওয়ার খবর পাচ্ছে তারা। ঘটনার পেছনের কারণ বুঝতে না পারলেও শিশু-কিশোরেরা নিজেদের মতো করে ঘটনার ব্যাখ্যা করে নিচ্ছে। বেশ কিছুদিন ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় শিশুদের দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব পড়েছে। বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ও ঘরবন্দী হয়ে গেছে তারা। টেলিভিশনে পছন্দের মেট্রোরেলসহ বিভিন্ন স্থাপনা পুড়ে যেতে দেখছে। শিশু-কিশোরদেরও পিটিএসডি হতে পারে। আগ্রাসী আচরণ, সামাজিক দক্ষতা কমে যাওয়ার পাশাপাশি ব্যক্তিত্ব বিকাশে সমস্যা দেখা দিতে পারে।
মানসিক চাপ মোকাবিলার কোনো উপায় আছে কি?
ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ: যে ঘটনা ঘটে গেছে, তা থেকে পিছিয়ে যাওয়া বা পেছনে তাকানোর সুযোগ নেই। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে গেলে সে চাপ থেকে মুক্ত হওয়া কঠিন। তারপরও মানুষকে স্বাভাবিক জীবনযাপনে আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ বাড়াতে হবে। কাজে মনোযোগ বাড়াতে হবে। মূলকথা, সেলফ কেয়ার বা নিজের যত্ন নিতে হবে। আর পিটিএসডির লক্ষণ দেখা দিলে যথাযথ চিকিৎসা নিতে হবে।