কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে টানা ছয় দিন ধরে দেশজুড়ে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রয়েছে। কয়েক বছরে ইউটিউব ও ফেসবুককে কেন্দ্র করে নাটকের যে ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, তা অনেকটা থমকে গেছে।
৩৩টির মতো প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে মুক্তির জন্য নাটক নির্মাণ করে। নাটকের অংশবিশেষ (ক্লিপ) ফেসবুকে প্রকাশ করেন। ইউটিউব ও ফেসবুক থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ অর্থ আয় করেছে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। টিভি নাটকের বাইরে কয়েক বছরে ইউটিউবের নাটকের আলাদা ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। দেশের বাইরে থেকে বিপুল অর্থ আসে।
ইন্টারনেট বন্ধ হওয়ায় বড় অঙ্কের লোকসানের মুখে পড়েছে ইউটিউবভিত্তিক প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো। ৫০টির মতো নতুন নাটকের মুক্তি আটকে গেছে।
গত বুধবার থেকে দেশজুড়ে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করেছে সরকার। বৃহস্পতিবার থেকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবাও মিলছে না। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, ইন্টারনেট বন্ধে আয় তো কমেছেই। পাশাপাশি ভবিষ্যতে এসব ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেজে দর্শকও কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। ফলে আগে এখান থেকে আয়ের যে ধারাবাহিকতা ছিল, সেখানেও প্রভাব পড়বে।
প্রযোজকেরা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে নতুন বিনিয়োগ করা কনটেন্টও মুক্তি দেওয়া যাচ্ছে না। এতে করে এই সব প্রতিষ্ঠানের প্রায় পাঁচ কোটি টাকার নতুন বিনিয়োগ আটকে গেছে। এ ছাড়া গত ঈদের সময় বড় অঙ্কের বিনিয়োগে যেসব নাটক মুক্তি দেওয়া হয়েছে, সেসব নাটক থেকে কত দিনে পুঁজি ফিরবে, তা নিয়েও দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তাঁরা।
সিএমভি ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেজ থেকে প্রতিদিনের আয় প্রায় দুই লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার সাহেদ আলী জানান, গত পাঁচ দিনে প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ১০ লাখ টাকা আয় হারিয়েছে। পাশাপাশি নির্ধারিত শিডিউলে দুটি নাটক মুক্তির কথা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি।
সাহেদ আলী বলেন, ‘প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা লোকসান তো হচ্ছেই, পাশাপাশি কনটেন্টের স্পন্সরও বাতিল হয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হলো, ভবিষ্যতে চ্যানেল ও ফেসবুক পেজের রিচ কমে যাবে। নতুন নতুন যেসব কনটেন্ট মুক্তি পাবে, কনটেন্টগুলোর স্বাভাবিক আয় কমবে। সম্ভাবনাময় এই ইন্ডাস্ট্রির বড় ক্ষতি হয়ে গেল। পিছিয়ে গেলাম আমরা।’
সাহেদ আলী জানান, গত শুক্রবার অবুঝ পাখি ও কাপল অব দ্য ক্যাম্পাস নামে দুটি কনটেন্ট মুক্তি দেওয়ার কথা ছিল। তবে সেটি স্থগিত করা হয়েছে। দুই নাটকে প্রায় ২৫ লাখ টাকার বিনিয়োগ রয়েছে।
আরেক প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান গোল্লাছুট জানিয়েছে, গত ছয় দিনে ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেজ থেকে প্রায় আট লাখ টাকার আয় কমেছে। পাশাপাশি কিস্তির ছাড় ও পজিশন ঠিক নাই নামে দুটি কনটেন্টের মুক্তি আটকে গেছে।
গোল্লাছুটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহিন কবির টুটুল বলেন, ‘মূলত ইউটিউব ও ফেসবুক ঘিরেই আমাদের নাটকের ব্যবসা। কিন্তু মাধ্যমগুলো বন্ধ থাকার কারণে আয়ও বন্ধ হয়ে গেছে। বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ এখানে। প্রতিদিনই লাখ লাখ টাকা আয় কমছে। কত দিন এভাবে বন্ধ থাকবে, তা–ও জানি না। প্রতিষ্ঠানের পেছনে মাসে অনেক খরচ। খুবই চিন্তায় আছি।’
ইউটিউব ও ফেসবুক থেকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় তিন লাখ টাকা করে আয় করে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জি-সিরিজ। এর মধ্যে ১৫ লাখ টাকার বেশি আয় হারিয়েছে বলে ধারণা করছে প্রতিষ্ঠানটি। পাশাপাশি চলতি সপ্তাহে তিনটি নতুন নাটকের মুক্তির শিডিউল বাতিল হয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছে বড় এই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানটি।
প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার নাজমুল ভুঁইয়া বলেন, ‘শুধু নাটকের নয়, সিনেমা ও গান মিলে আমার প্রতিষ্ঠানের পাঁচটি ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেজ। এখানে কোটি কোটি টাকার বিনিয়োগ আছে। ইন্টারনেট বন্ধের কারণে সব মাধ্যমের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। প্রতিদিনই লাখ লাখ টাকার আয় হারাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। মাসে এই প্রতিষ্ঠানের খরচ কোটি টাকা। এভাবে চলতে থাকলে মাস শেষে কীভাবে কী করব, বুঝতে পারছি না।’
এই প্রযোজক আরও বলেন, ‘আগে ইউটিউব ও ফেসবুকে দর্শকের কনটেন্ট দেখার যে ফ্লো ছিল, হঠাৎ করে ইন্টারনেট বন্ধের কারণে বড় রকমের ধাক্কা খেয়েছে। কনটেন্টগুলোতে দর্শকের স্বাভাবিক অংশগ্রহণ হতে বছর লেগে যেতে পারে।’
এদিকে ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেজ থেকে গত পাঁচ দিনে প্রায় ১০ লাখ টাকা আয় হারিয়েছে বলে মনে করছে আরেক প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সিনেমাওয়ালা। নির্ধারিত শিডিউলে ম্যাজিক মোমেন্ট নামে একটি নাটকের মুক্তিও আটকে গেছে।
প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ বলেন, ‘ইউটিউব ও ফেসবুক ঘিরে কনটেন্ট ব্যবসার বড় একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে এই পরিস্থিতিতে গত পাঁচ দিনে কোটি কোটি টাকা ক্ষতি হয়ে গেছে এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোর। হয়তো আবার সবকিছু চালু হবে, কিন্তু এই ব্যবসা স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে।’