হাতে তৈরি যেকোনো পণ্যের সমাদর বিশ্বজুড়ে। স্বর্ণালঙ্কার ও গহনার ক্ষেত্রে এই চাহিদা যেন আরও বেশি।তবে হাতে অলঙ্কার তৈরির ক্ষেত্রে স্বর্ণের অপচয় হয় অনেকটা, সময়ও লাগে বেশি। মূল্যবান এই ধাতুর অপচয় রোধ ও কারিগরদের সময় বাঁচাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্বর্ণালঙ্কার তৈরিতে ব্যবহার করা হয় আধুনিক মেশিনারিজ। যা বাংলাদেশে এখনো খুব একটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। সনাতন পদ্ধতিতেই গহনা তৈরি করেন দেশের কারিগররা।
তাইতো স্বর্ণ ব্যবসায়ী ও কারিগরদের গহনা তৈরির বিভিন্ন আধুনিক মেশিনারিজের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে এবং দেশের স্বর্ণশিল্পকে আধুনিক করে তুলতে রাজধানীতে প্রথমবারের মতো আয়োজন করা হয়েছে আন্তর্জাতিক জুয়েলারি মেশিনারিজ প্রদর্শনী বাংলাদেশ (আইজেএমইবি)-২০২৪। ‘গহনায় হোক প্রযুক্তির ছোঁয়া’—প্রতিপাদ্য নিয়ে যৌথভাবে আন্তর্জাতিক এই প্রদর্শনীর আয়োজন করে দেশের ঐতিহ্যবাহী ও পণ্যভিত্তিক সর্ববৃহৎ বাণিজ্য সংগঠন বাজুস ও ভারতীয় প্রতিষ্ঠান কেএনসি সার্ভিসেস।
গত বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) রাজধানীর ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরার (আইসিসিবি) পুষ্পগুচ্ছ হলে শুরু হয় এই আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী। তিন দিনব্যাপী এই প্রদর্শনীর পর্দা নামছে শনিবার (৬ জুলাই) সন্ধ্যায়।
প্রদর্শনীর সমাপনী দিনে আইসিসিবির পুষ্পগুচ্ছ হলে গিয়ে দেখা যায়, স্বর্ণশিল্পের সঙ্গে জড়িতরা প্রদর্শনীর বিভিন্ন স্টল ঘুরে আধুনিক সব মেশিনারিজ সম্পর্কে জানছেন। প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানিও তাদের তৈরি মেশিনারিজ সম্পর্কে দর্শনার্থীদের জানাচ্ছে। অনেকে কোম্পানি এই প্রদর্শনী উপলক্ষে ক্রেতাদের বিশেষ ছাড় ও সুবিধাও দিচ্ছে।
আয়োজকরা জানান, দেশে প্রথমবারের মতো আয়োজিত আন্তর্জাতিক এই প্রদর্শনীতে ভারত, ইতালি, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জার্মানি, চীন ও থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের ১০টি দেশের প্রায় ৩০টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে।
আন্তর্জাতিক এই প্রদর্শনীতে একই ছাদের দেশ-বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানি তাদের তৈরিকৃত ও আমদানিকৃত মেশিনারিজ প্রদর্শন করায় একদিকে যেমন স্বর্ণ ব্যবসায়ী ও কারিগররা আধুনিক মেশিনারিজ সম্পর্কে বিস্তৃত ধারণা পাচ্ছেন, অন্যদিকে কোম্পানিগুলোও একে অপরের পণ্য সম্পর্কে জানতে পারছেন।
বিশ্বের সাতটি দেশের সাতটি কোম্পানির প্রায় ২০ ধরনের মেশিন বিক্রি করে ট্রাস্ট ইন্সট্রুমেন্ট বাংলাদেশ। মূলত, স্বর্ণের মান নিয়ন্ত্রণ, মান পরীক্ষা ও হলমার্ক ল্যাব স্থাপনের বিভিন্ন মেশিনারিজ বিক্রি করে এই প্রতিষ্ঠান। যার বেশিরভাগই আনা হয় জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীন থেকে। প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া এই প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজিং পার্টনার তৌকির আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, একই ছাদের নিচে দেশ-বিদেশের অনেক কোম্পানির স্টল থাকায় ক্রেতারা স্বর্ণ তৈরির বিভিন্ন মেশিন সম্পর্কে জানতে পারছে, দাম দেখতে পারছে। তারপর চিন্তাভাবনা করে তার জন্য কোন মেশিনটি উপযুক্ত সেটি কেনার সিদ্ধান্ত নিতে পারছে। প্রদর্শনী উপলক্ষে আমরা বেশ কিছু মূল্য ছাড় ও অফার দিচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, হাতে তৈরি স্বর্ণালঙ্কারের চেয়ে ভালো আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু এতে সময় নষ্ট হয়। আধুনিক মেশিনের মাধ্যমে স্বর্ণালঙ্কার তৈরি করলে কম সময়ে অনেক স্বর্ণালঙ্কার তৈরি করা যায়। তবে মেশিনে ডিজাইনের ক্ষেত্রে অনেক ভিন্নতা পাওয়া যায় না। যেখানে কারিগররা প্রায় প্রতিটি গহনা তৈরিতে আলাদা ডিজাইন করতে পারেন।
বন্দর নগরী চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠান রাজেশ্বরীর মেশিন ইঞ্জিনিয়ার অসীম সেন বলেন, আগে স্বর্ণ কিনে মানুষ ঠকতো। কিন্তু এখন আধুনিক মেশিন থাকায় ক্রেতাদের স্বর্ণালঙ্কার কেনার ক্ষেত্রে ঠকার সুযোগ নেই। এছাড়া হাতে তৈরি স্বর্ণালঙ্কারে ত্রুটি যেমন থাকে, তেমনি স্বর্ণের অপচয়ও হয়, সময়ও লাগে বেশি। কিন্তু মেশিনের মাধ্যমে স্বর্ণালঙ্কার তৈরি করলে গহনায় যেমন ত্রুটি থাকে না, তেমনি সেগুলো তৈরিতে স্বর্ণের অপচয় কম হয়, সময়ও কম লাগে। হাতে গহনা তৈরিতে ১০-১৫ শতাংশ স্বর্ণ নষ্ট হয়। মেশিনের মাধ্যমে যা ৩-৪ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব।
জার্মান প্রতিষ্ঠান একজেটের ২০টিরও বেশি মেশিনারিজ বাংলাদেশ পরিবেশন করে আর এন মাইক্রোটেক। প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক অর্পন ধর বাংলানিউজকে বলেন, মেশিনের মাধ্যমে স্বর্ণালঙ্কার তৈরি করলে ফিনিশিংটা ভালো হয়, স্বর্ণের মানও ভালো থাকে। যেখানে হাতে গহনা তৈরি করতে গেলে প্রায় ১০ শতাংশের মতো স্বর্ণ অপচয় হয়, সেখানে মেশিনের মাধ্যমে স্বর্ণালঙ্কার তৈরি করলে তা ২-৩ শতাংশে নেমে আসে। এই ২-৩ শতাংশ স্বর্ণও নষ্ট হয় মূলত মেশিন থেকে স্বর্ণ বের করার সময়। মেশিনে গহনা তৈরিতে কোনো স্বর্ণই নষ্ট হয় না।
এসব বিষয়ে বাজুসের সাবেক সহ-সভাপতি ও বর্তমান কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য আনোয়ার হোসেন বলেন, স্বর্ণালঙ্কার তৈরিতে স্বর্ণের অপচয় যত বাড়বে, তত স্বর্ণের দাম বাড়বে, মজুরি বেড়ে যাবে। হাতে গহনা তৈরি করলে কারিগরদের ১২ শতাংশ স্বর্ণ নষ্ট হয়। আধুনিক প্রযুক্তিতে এই অপচয় হয় ২-৩ শতাংশ। এই অপচয়টাই আমরা রোধ করতে চাচ্ছি। তাই গহনা তৈরির যেসব উপাদান মেশিনে তৈরি করা যায়, সেগুলো মেশিনে তৈরি করে তারপর কারিগররা হাতের মাধ্যমে নকশা করলে গহনাও ইউনিক হবে এবং অপচয়ও কম হবে। মজুরিও সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে।
জুয়েলারি শিল্পের কারিগর ও প্রস্তুতকারকদের সঙ্গে আধুনিক মেশিনারিজের সঙ্গে পরিচিত করাতেই এই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, সারা পৃথিবী আধুনিক হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমরা এখনো এই প্রযুক্তি নিতে পারিনি। আমাদের কারিগররা যেন আধুনিক মেশিনারিজের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে এবং প্রয়োজনীয় মেশিন কিনতে পারে তাই এই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। আমাদের স্বর্ণশিল্প যেন কারিগরদের হাতের ছোঁয়ায় ও প্রযুক্তি মাধ্যমে আরও উৎকর্ষতা লাভ করে এটাই আমাদের উদ্দেশ্য।