রাজশাহীর নওহাটা থেকে ‘তুফান’ সিনেমা দেখতে রাজতিলক সিনেমা হলে এসেছিলেন এক নারী। সঙ্গে তাঁর মেয়ে। সন্ধ্যার শো দেখার জন্য তিনি টিকিট পাচ্ছিলেন না। সিনেমার প্রদর্শন শুরুর ২ মিনিট আগে তিনি পেয়ে যান হলমালিককে। হলমালিক হাতজোড় করে বললেন, ‘এই শোতে আর টিকিট দিতে পারছি না, আপা। আমাদের জানিয়ে আসলে ভালো হতো। আমরা নারী দর্শককে সর্বোচ্চ প্রায়োরিটি দিই। সন্ধ্যার এই শোতে আর টিকিট নাই।’ ওই নারী বলতে থাকেন, ‘এত দূরের পথ থেকে এসেছি। কোনো ব্যবস্থা করা যায় কি না।’ পরে হলমালিক দুটো বসার টোল সংগ্রহ করে হলের ভেতরে নিয়ে গেলেন তাঁদের। সিনেমা শুরু হয়ে গেল।
এই দৃশ্য রাজশাহীর পবা উপজেলার কাটাখালী পৌরসভার রাজতিলক সিনেমা হলের। দিনের তৃতীয় শো সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার আগে এই দৃশ্য চোখে পড়ে। এই শো দেখতে না পেরে ২০ জনের মতো সিনেমাপ্রেমীকে বাইরে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। তাঁরা রাত সাড়ে ৯টার শো দেখবেন।
রাজশাহী নগরের হাদির মোড় থেকে শারমিন আক্তার সপরিবার সিনেমা দেখতে এসেছেন। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে তাঁরা এসে কাটাখালীতে পৌঁছান। তাঁর স্বামী টিকিট কাটতে গিয়ে ফিরে আসেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার টিকিট নেই।
পরে আবার গিয়ে দেখেন নিচের তলার টিকিটও ফুরিয়ে গেছে। পরে তাঁরা হলের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে টিকিট কাটেন। শারমিন বলেন, রাজশাহী শহরে আগে অনেক সিনেমা হল ছিল। কিন্তু এখন আর নেই। শহরের বাইরে রাজশাহীর একমাত্র সচল হল রাজতিলক। বাংলা সিনেমা পছন্দ করেন তিনি। এ কারণে প্রায়ই তাঁরা সিনেমা দেখতে হলে ছুটে আসেন।
এই দুই পরিবার টিকিট পেলেও রাজশাহী নগরের মেহেরচণ্ডী এলাকার এক দম্পতি টিকিট পাননি। স্ত্রীকে বসিয়ে রেখে বাইরে অপেক্ষা করছিলেন। নাম বললেন না। তিনি বলেন, আগেভাগেই এসেছেন। আজ যে টিকিট পাওয়া যাবে না, এটা জানতেন না। মোটরসাইকেলও গ্যারেজ করা হয়ে গেছে। এখন সিনেমা দেখার জন্য প্রায় তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। তাঁদের মতো রাসেল মিয়া, মো. সবুজ, সাদেক আলী, আল-আমিনসহ আরও বেশ কয়েকজনকে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে।
রায়হান রাফী পরিচালিত ‘তুফান’ সিনেমায় শাকিবের বিপরীতে অভিনয় করেছেন ভারতের মিমি চক্রবর্তী। রয়েছেন চঞ্চল চৌধুরী, মাসুমা রহমান নাবিলা, ফজলুর রহমান বাবু, গাজী রাকায়েত, সালাহউদ্দিন লাভলু, গাউসুল আলম শাওন প্রমুখ। ‘তুফান’ ছবিটি প্রযোজনা করেছে আলফা-আই স্টুডিওজ লিমিটেড; ডিজিটাল পার্টনার চরকি এবং ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবে আছে এসভিএফ।
রাজশাহীর কাটাখালীর এই সিনেমা হলে বেলা সাড়ে তিনটার প্রদর্শন দেখে বের হন নাটোরের ১১ জন দর্শক। তাঁদের পাঁচজন মোটরসাইকেলে আর বাকিরা বাসে করে রাজশাহীতে এসেছেন ‘তুফান’ সিনেমা দেখতে। সিনেমা দেখে বের হয়েই সিনেমা নিয়ে একে অপরের সঙ্গে কথা বলছিলেন। একজন বলেন সিনেমাটার শেষটা দুর্দান্ত। আরেকজন বললেন, ‘ভারতের সিনেমার মতো টানটান উত্তেজনা পেলাম।’ এই দলের তরুণ মো. জিসান বলেন, ‘অনেক দিন পর সিনেমা দেখলাম। এমন সিনেমা বানালে দেখতে হবে। শাকিবের দ্বৈত চরিত্র ভালো লেগেছে।’
রাজশাহী শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে বাগমারা উপজেলা থেকে রাকিব হাসানসহ তিনজন একটি মোটরসাইকেলে করেই এসেছেন। রাকিব বলেন, প্রতি ঈদেই সিনেমা দেখতে আসেন। দূরের পথ বলে বেলা সাড়ে তিনটার শোর টিকিটে সিনেমা দেখেছেন। হলের পরিবেশ ভালো। সিনেমা ফাটাফাটি। শাকিব খান এ জন্যই বাংলাদেশের সুপারস্টার। তিনি চঞ্চল চৌধুরীর সংলাপ কয়েকবার শোনান, ‘তুফান, খুব ভয় পাইছি রে…।’
রাজশাহী শহরের শেষ সিনেমা হলটি বন্ধ হয়ে যায় ২০১৮ সালের ১২ অক্টোবর। এরপর বন্ধ হয় পবা উপজেলার বাবুল হল। পুরো রাজশাহী জেলা হয়ে পড়ে সিনেমা হলশূন্য। এরপর ২০২৩ সালের ১৭ মার্চ ‘হাওয়া’ সিনেমা প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে চালু হয় রাজতিলক সিনেমা হল। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রাজতিলক হলে সর্বশেষ ২০১২ সালে সিনেমা প্রদর্শন করা হয়। তখন ‘কমন জেন্ডার’ সিনেমা চলাকালে হলটি বন্ধ হয়ে যায়। তখন চাঁপাইনবাবগঞ্জের রুম্মান আলী হলটি কিনে নেন। এরপর আর হলটি চালু হয়নি। পরে এটি ২০২২ সালে মালিকের কাছ থেকে পাঁচ বছরের জন্য ভাড়া নেন দিনাজপুরের ফুলবাড়ী এলাকার সাজ্জাদ হোসেন।
তিনি মূলত চলচ্চিত্রে প্রোডাকশন ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেন, থাকেন ঢাকায়। তিনি হলটি চালুর উদ্যোগ নেন। পরে তিনি হলটি চালু করেন। চলতি বছর এক বছরের মাথায় হলে তিনি শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বসান। ঈদের আগে সাউন্ড সিস্টেমও ডিজিটাল করেছেন। হলটিতে বর্তমানে ৪৮৫ জন দর্শক একসঙ্গে বসে সিনেমা দেখতে পারেন।
হলটি চালুর পর থেকেই কাটাখালী পৌর বাজার জমজমাট হয়েছে। বিশেষ করে ঈদ মৌসুমে ভাজাপোড়া, কোমল পানীয়সহ খাবারের দোকানে ক্রেতা বেড়েছে। এই হলকে কেন্দ্র করে হলেরই টিকিট চেকার মো. মোস্তাকিন মোটরসাইকেল ও সাইকেল রাখার গ্যারেজ করেছেন।
হলের পাশেই কোমল পানীয়সহ চিপস, পান বিক্রি করেন মো. ডলার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভালো সিনেমা হলে এলে ব্যবসা ভালো হয়। আজকে তো দেখতেই পেলাম কতগুলো জিনিস বিক্রি করলাম। হলে এলে মানুষ কিছু কিনে হলের ভেতরে যায়। ঝালমুড়ি বিক্রেতা হাবিবুর রহমানের বিক্রিও ভালো।’ তিনি বলেন, সারা বছর এ রকম সিনেমা থাকলে মানুষ হবে। তাঁদের বিক্রিও হবে।
গ্যারেজ মালিক মোস্তাকিন বলেন, দর্শক এলে কাটাখালী পৌরসভায় মানুষের আনাগোনা বেড়ে যায়। অনেকেই কেনাকাটা করে। এতে করে এখানকার অর্থনৈতিক অবস্থাও সচল হয়েছে।
হলমালিক সাজ্জাদ হোসেন (সাগর) বলেন, ‘সিনেমা হলে দর্শক এলে ভালো লাগে। আজকে ছুটির দিন। অনেক দর্শক এসেছে। তবে দুপুর ও বিকেলে শোতে বেশি দর্শক ছিল না। দর্শক যাতে হলে এসে সিনেমা দেখে পরিবেশ নিয়ে কোনোরকম আপত্তি না করেন, তার সব ব্যবস্থাই করেছি।’