আসন্ন ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে পাল্লা দিয়ে কাজ করে চলেছেন বগুড়ার সেমাই পল্লীর কারিগররা। তৈরি করছেন চিকন সাদা সেমাই।
বুধবার (২৭ মার্চ) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত জেলার সদর ও শাজাহানপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকার সেমাই পল্লীর কারখানাগুলো ঘুরে মালিক ও কারিগরদের সঙ্গে কথা হলে এমন তথ্য জানা গেছে।
মুসলিমদের প্রধান উৎসব ঈদুল ফিতর। আর তাই ঈদকে সামনে রেখে সচল হয়ে উঠেছে বগুড়ার সেমাই পল্লীর কারখানাগুলো। ব্যস্ত স্বপ্নবাজ কারিগররা। তৈরি করছেন মজাদার চিকন সাদা সেমাই। তবে গেল কয়েকদিন বৃষ্টি ও মেধলা আকাশ অনেকটা বাগড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। ফলে চাহিদা মোতাবেক সেমাই উৎপাদন করতে পারছেন না মালিকরা।
কারখানাগুলো ঘুরে দেখা যায়, সেমাই তৈরির কারিগরদের দম ফেলার ফুরসত নেই। রাত-দিন সমানে তারা সেমাই তৈরি করছেন। দিনের আলোয় সেই সেমাই শুকাচ্ছেন। আবহাওয়া প্রতিকূলে গেলে বিশেষ ব্যবস্থায় হিট দিয়ে শুকানো হচ্ছে সেমাই। আর পুরো প্রক্রিয়ায় জড়িতদের সিংহভাগই নারী।
সদর ও পাশের শাজাহানপুর উপজেলার প্রায় ১০ গ্রাম নিয়ে গড়ে উঠেছে সেমাই পল্লী। এসব গ্রামে অন্তত শতাধিক কারখানা রয়েছে। যেখানে পাঁচ থেকে সাত শতাধিক কারিগর কাজ করেন। যার ৯০ শতাংশই নারী কারিগর। বাড়তি আয়ের জন্য অনেকেই যুক্ত হয়েছেন এ পেশায়। আর তাদের হাতের ছোঁয়ায় ময়দা হয়ে যায় চিকন সেমাই।
বগুড়ার সদর ও শাজাহানপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে সেমাই কারখানার মালিক ও কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেজোড়া একটি গ্রামের নাম। শাজাহানপুর উপজেলার মাদলা ইউনিয়নে গ্রামটির অবস্থান। সম্ভবত এ গ্রাম থেকেই চিকন সাদা সেমাইয়ের জন্ম। স্বাধীনতার পর এ গ্রামের কয়েকটি পরিবার চিকন সেমাই তৈরি শুরু করেন। তবে সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ জানা যায়নি। সময়ের ব্যবধানে এ শিল্প বিভিন্ন গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে এখানকার তৈরি চিকন সাদা সেমাইয়ের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দেশের নানা প্রান্তে। সারা বছরই কমবেশি সাদা সেমাই তৈরি করা হয় গ্রামটিতে।
বছরের অন্য সময়ের চেয়ে রমজান ও প্রত্যেক ঈদে সেমাইয়ের উৎপাদন বেড়ে যায় কয়েকগুণ। মূলত শবে বরাতের পর থেকেই শুরু হয় সেমাই উৎপাদন। গ্রামের প্রত্যেক বাড়িই যেন একেকটি কারখানা। প্রত্যেক কারখানায় গড়ে প্রতিদিন প্রায় চারশ-পাঁচশ কেজি অর্থাৎ ২০ খাঁচি সেমাই তৈরি করা হয়।
বাঁশবারিয়া এলাকার কারখানা মালিক কাফি মিয়া, বেজোড়া এলাকার সাইদুর ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, রমজান শুরুর আগে থেকেই সেমাই পল্লীগুলো ব্যস্ত হয়ে ওঠে। চিকন সাদা সেমাই তৈরিতে পাড়ায় পাড়ায় শুরু হয় মালিক ও কারিগরদের ব্যস্ততা। এ পেশার সঙ্গে যুক্ত বেশির ভাগ শ্রমিকই নারী।
তারা জানান, বেজোড়া গ্রামে এ শিল্প যারা গড়ে তোলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম দুলু মিয়া। তিনি প্রায় ২৩-২৪ বছর আগে মারা গেছেন। সদর ও শাজাহানপুর উপজেলায় প্রায় ১০-১২ গ্রামে গড়ে উঠেছে সেমাই পল্লি। বেজোড়া এলাকায় শতাধিকের মতো সেমাই তৈরির কারখানা রয়েছে। পাঁচ থেকে সাত শতাধিক নারী শ্রমিক প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে এ পেশার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।
কারখানার মালিকরা জানান, ঈদের আগে প্রত্যেক কারখানায় গড়ে প্রতিদিন প্রায় চারশ থেকে পাঁচশ কেজির মতো ময়দা থেকে সাদা সেমাই তৈরি করা হয়। যার পরিমাণ প্রায় ২০ খাঁচির বেশি। শ্রমিকরা প্রতি বস্তা (৩৭ কেজি) ময়দা দিয়ে সেমাই তৈরি করে পারিশ্রমিক পান ১৫০ টাকা করে।
নার্গিস, সাবিহা, শামীমাসহ একাধিক নারী শ্রমিক বাংলানিউজকে জানান, চাহিদা মোতাবেক সারা বছরই তারা সেমাই কারখানায় কাজ করেন। তবে প্রত্যেক বছরের ঈদের আগ মুহূর্তে এ পেশার সঙ্গে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক যুক্ত হন। যাদের বেশির ভাগ নারী। ঈদের সময় প্রতিটি কারখানায় উৎপাদন বেড়ে যায় কয়েকগুণ।
তারা জানান, অভাবেবর সংসার তাদের। স্বামীর একার আয়ে সংসার চলানো কষ্টকর। অনেক নারীর স্বামী নেই। তাদের ক্ষেত্রে সংসার চালানো আরও কষ্টকর। তাই বিভিন্ন সেমাই কারখানায় কাজ করেন তারা। এতে বাড়তি আয় হয়। এতে সংসার বেশ ভালোই চলে। তাদের ছয়জনের একটি দল দিনে ১০ থেকে ১২ বস্তা ময়দার সেমাই তৈরি করেন। দিন শেষে তারা আড়াইশ থেকে তিনশ টাকা হিসেবে পারিশ্রমিক পান। এ বাড়তি আয় স্বামীর আয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়। আর তাতে সংসার বেশ ভালোই চলে বলে জানান তারা।
খ্যাতির এ সেমাইটার রঙ সাদা হলেও এখানে শ্রমিকদের স্বপ্নটা রঙিন। ঈদুল ফিতরের উৎসবকে ঘিরে চিকন সাদা সেমাইয়ে রঙিন স্বপ্নে বিভোর এ স্বপ্নবাজরা। চিকন সেমাই কিনতে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা বগুড়ায় আসেন। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রংপুর, নওগাঁ, জয়পুরহাট, নীলফামারীসহ বিভিন্ন জেলা শহরে প্রতিনিয়ত ট্রাক ও বাসে করে সেমাই নিয়ে যান ব্যবসায়ীরা।