ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)। তিনি নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছেন। দুই দলের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ও সংঘাত, সংবিধানের মধ্যে থেকে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় নির্বাচন নিয়ে অনড় অবস্থান, বিদেশিদের চাপ ও মার্কিন কংগ্রেসম্যানদের চিঠি—এসব বিষয়ে কথা বলেছেন
বাধা থাকা সত্ত্বেও বিএনপি ও অন্য বিরোধী দলগুলো রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করছিল। আওয়ামী লীগও পাল্টা কর্মসূচি পালন করছিল। শুক্রবার দুই দলই ঢাকায় বড় কর্মসূচি পালন করে। পরদিন শনিবারই আমরা সংঘাত-সহিংসতা দেখতে পেলাম। রাজনীতি কোন দিকে এগোচ্ছে?
এম সাখাওয়াত হোসেন: রাজনৈতিক সংঘাত মোটেই কাম্য নয়। যখন পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি থাকে এবং দুই পক্ষই খুব কাছাকাছি অবস্থানে থাকে, তখন কে কী করছে, সেটা বলা মুশকিল। শনিবার বিএনপির কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগ মাঠে নেমেছিল। পুলিশের সঙ্গে মিলে বিএনপির লোকজনকে উঠিয়ে দেওয়া ও ধাওয়া দেওয়ার কাজটা তারা করেছে। এ ঘটনা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তোলে। বাস পোড়ানো হয়েছে, তা নিয়ে বাদানুবাদ চলছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা ধরনের কথাবার্তা হচ্ছে। একে অপরকে দোষারোপ করছে।
সম্প্রতি দুই দলই বড় কর্মসূচি পালন করেছে, সেসব কর্মসূচিতে তারা শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রেখেছে। এ কারণে শনিবারের সংঘাতকে আমি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখতে চাই। সোমবার বিএনপির কর্মসূচির দিনে আওয়ামী লীগ কর্মসূচি দিয়ে প্রত্যাহার করেছে। এটা রাজনীতির জন্য একটা ভালো লক্ষণ। সংঘাতে লিপ্ত হলে সেটা এবার কারও জন্য খুব একটা সুখকর হবে বলে মনে করি না।
বিএনপি ও বিরোধী দলগুলো তাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে অনড়। আওয়ামী লীগ বলছে, সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। তাহলে সমাধান কী?
এম সাখাওয়াত হোসেন: আওয়ামী লীগ বলেছে সংবিধানের বাইরে তারা যাবে না। বিএনপি বলেছে তারা নিরপেক্ষ সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন করবে না। এটা নির্দিষ্টভাবে তাদের দাবি আদায়ের বিষয়। বর্তমান সরকারের অধীন যে দুটো নির্বাচন হয়েছে, তার একটা তো একেবারেই জালিয়াতিপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে। ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছে। আর ২০১৮ সালের নির্বাচনের ব্যাপারে খোদ সে সময়কার নির্বাচন কমিশনের লোকজনই বলেছেন, অনেক জায়গায় রাতে ভোট হয়েছে। সেই নির্বাচন কমিশনের প্রয়াত মাহবুব তালুকদার তাঁর নির্বাচননামা বইয়ে এ নির্বাচন নিয়ে স্পষ্ট করে লিখে গেছেন। এসব কারণে শুধু বিএনপি নয়, যাঁরা সাধারণ ভোটার, তাঁরাও মনে করেন এমন একটা পরিস্থিতিতে নির্বাচন হোক, যাতে করে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও স্বচ্ছভাবে কাজ করতে পারে। এ জায়গা থেকে আমার মনে হয়, এবারের নির্বাচনটা যদি সর্বজনীন করতে হয়, তাহলে সরকারি দলকে নির্দিষ্টভাবেই ছাড় দিতে হবে।
সংসদ ভাঙার পরও নির্বাচন হতে পারে সেই বিধান সংবিধানের মধ্যেই আছে। সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদে বিধান আছে। মেয়াদ অবসানের মেয়াদ অবসান ছাড়া কোনো কারণে সংসদ যদি ভেঙে যায়, তাহলে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। সংসদ ভেঙে যাওয়া মানে মন্ত্রিসভা ভেঙে যাবে এবং রাষ্ট্রপতির নির্দেশে নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হবে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনেরও দৃষ্টান্ত আছে। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিপরিষদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করেছিলেন। কিন্তু আমরা কেউই এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছি না।
অনেকে ভারত ও যুক্তরাজ্যের নির্বাচনী ব্যবস্থার দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন।
এম সাখাওয়াত হোসেন: এখানে মূল দেখার বিষয় হচ্ছে সংস্কৃতি। ভারতে মূলত প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থাতেই নির্বাচন হয়। সেখানে কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকার দুই ব্যবস্থা চালু আছে। কেন্দ্রে যে সরকার আছে, রাজ্যে সেই একই দলের সরকার না-ও থাকতে পারে। এ কারণে একটা ভারসাম্যমূলক অবস্থা বজায় থাকে। ভারতে নির্বাচন করান আমলারা। এত বড় আমলাতন্ত্রকে রাজনীতিকরণ করা খুব কঠিন। প্রতিটি রাজ্যের জন্য আলাদা সিইও বা প্রধান নির্বাচনী কর্মকর্তা থাকেন। নির্বাচন কমিশন সেখানে বিকেন্দ্রীভূত। নির্বাচনের সময় সিআরপি বা সেন্ট্রাল রিজার্ভ ফোর্স নিয়োজিত থাকে। ভারতে আমলারা রাজনৈতিকভাবে পক্ষভুক্ত হয়েছে, নির্বাচন কমিশন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, সামগ্রিকভাবে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, এমনটা শোনা যায় না। নির্বাচন নিয়ে ভারতে আলাদা সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।
ওয়েস্টমিনস্টারে সরকারই তো বদল হয়ে যায় দুই বছর, এক বছর পরপর। দলের অনাস্থা থাকলে প্রধানমন্ত্রী বদল হয়ে যায়। অগ্রসর গণতন্ত্রের দেশগুলোতে যে দল হেরে যায়, সে দলের প্রধান পদত্যাগ করেন। তাঁর জায়গায় নতুন কেউ নেতৃত্বে আসেন। এ ধরনের সংস্কৃতি তো আমাদের এখানে নেই। ভারতে কিংবা যুক্তরাজ্যের উদাহরণ দেওয়ার সময় কেউ কিন্তু এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিচ্ছেন না অথবা ইচ্ছা করেই এড়িয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ ছোট একটা দেশ। এখানে এককেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থা চালু রয়েছে। সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ হয় ঢাকা থেকে। যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তারা ইউনিয়ন কি ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করে।
নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, রাজনীতিতে ততই অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে কী ধরনের শঙ্কা দেখছেন?
এম সাখাওয়াত হোসেন: এতগুলো বছরেও আমরা আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাটাকে ঠিক করতে পারিনি। প্রতি পাঁচ বছর পরপর নির্বাচন নিয়ে রাস্তায় হানাহানি, মারামারি হয়। তারপর একধরনের বন্দোবস্ত হয়। এটা আর কত দিন চলবে? আমাদের রাজনৈতিক পরিপক্বতা আসছে না, প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করছে না। যদি নির্বাচন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানের ওপর মানুষের আস্থা না থাকে, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠান তো কাজ করতে পারে না। প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি করতে পারে এমন দলগুলো এবারের নির্বাচনে না এলে সেই নির্বাচন নিয়ে শুরু থেকেই প্রশ্ন উঠবে।
অর্থনীতিবিদেরাই বলছেন, আমাদের অর্থনীতির অবস্থা খুব ভালো নয়। সরকারকে টাকা ছাপাতে হচ্ছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। জিনিসপত্রের দাম আর মূল্যস্ফীতি সবার জন্যই দুশ্চিন্তার কারণ। অর্থনীতির সব সূচকই বলছে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে নির্বাচনটাও যদি ভালো ও গ্রহণযোগ্য না হয় এবং তাতে যদি আন্তর্জাতিক চাপ আসে, তখন পরিস্থিতিটা বাংলাদেশ কতটা সামাল দিতে পারবে, তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
দুই দলই গণতন্ত্র রক্ষা, জনগণের ভোটাধিকার ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলছে। কিন্তু রাজপথ জয়ের সেই পুরোনো পথেই হাঁটছে। সমাধান কী?
এম সাখাওয়াত হোসেন: আমাদের রাজনীতিবিদেরা বলেন, রক্তপাত ও রাজপথের সংঘাত ছাড়া কোনো দিন কোনো দাবি আদায় হয়নি। এটা খুবই দুঃখজনক বাস্তবতা। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও কেন আমাদের সেই একই কথা শুনতে হবে, রাজপথে সংঘাত করতে হবে, রাজপথে মারামারি করতে হবে, বাসে আগুন দিতে হবে, তাহলে সরকার চাপে পড়বে। এটা কেন হবে? আমরা তো অনেক দিক থেকেই উন্নয়নের পথে আছি। তাহলে কেন এই সামাজিক সমস্যাটা সমাধান করতে পারিনি।
পরপর দুটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের পর অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের চাপ ক্রমেই বাড়ছে। জাতিসংঘে মার্কিন দূতকে দেওয়া এক চিঠিতে ১৪ জন কংগ্রেসম্যান বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে তাঁদের আস্থার সংকট রয়েছে। এ বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন।
এম সাখাওয়াত হোসেন: একটা স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশে নির্বাচন করার একটা দাবি এসেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই দাবি আমাদের দেশকে কোন কাতারে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল? যেসব দেশের কাতারে গিয়ে আমরা পড়লাম, সেসব দেশে তো আমাদের নিজস্ব সৈনিকেরা শান্তিরক্ষী বাহিনী হিসেবে কাজ করে, সেখানে তারা নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়তা করে, শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজ করে। হয়তো সে রকম কিছু হবে না, কিন্তু এটা একটা বাস্তবতা যে ১৪ জন মার্কিন কংগ্রেসম্যান জাতিসংঘে তাঁদের দূতকে চিঠি দিয়েছেন। আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখের ব্যাপার। আমরা কেন নিজেদের এই পর্যায়ে নিয়ে গেলাম? এখানে নাগরিক হিসেবে আমাদের আত্মমর্যাদার প্রশ্নটি জড়িত।
এত নিরাশার মাঝে আশার কোনো আলো দেখেন কি?
এম সাখাওয়াত হোসেন: আমি নিরাশ হতে চাই না। বাংলাদেশ আরও অনেক কঠিন কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছে। কোনো না কোনোভাবে আমরা বেরিয়ে এসেছি। আমি মনে করি, আমাদের রাজনীতিবিদেরা যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁদের এখন দায়িত্ব বেশি। যাঁরা বিরোধী দলে আছেন, তাঁদেরও দায়িত্ব আছে। যাঁরা প্রশাসনে আছেন, তাঁদের দায়িত্ব আছে। আমাদের তো সামনের দিকে এগোতে হবে।
আপনাকে ধন্যবাদ।
এম সাখাওয়াত হোসেন: আপনাকেও ধন্যবাদ।