জেনারেশন জেডকে সংক্ষেপে বলা হয় ‘জেন জি’। ’৯০ দশকের শেষ অংশ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে যাঁদের জন্ম, তাঁরাই জেন জি। অত সংজ্ঞায় না বেঁধে চাইলে ‘আজকালকার ছেলেপেলে’ বলেও তাদের ডাকতে পারেন, ক্ষতি নেই। ফেসবুক, ইউটিউব, মুঠোফোনের উত্থানের সঙ্গে তাঁদের বেড়ে ওঠা। প্রযুক্তির উৎকর্ষ জেন জি–দের জীবনকে শুধু যে সহজ ও গতিময় করেছে তা নয়, অনেক ক্ষেত্রে জটিলও করেছে। এই প্রজন্ম যখন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে শুরু করল, প্রযুক্তির ওপর তাঁদের সহজাত নির্ভরতাকেও সঙ্গে নিল। কিন্তু আগের প্রজন্ম বা তাঁদের কর্মস্থল কি এই পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত ছিল?
১১ এপ্রিল বিবিসিতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। শিরোনাম ‘হোয়াই জেন জি ওয়ার্কার্স আর স্টার্টিং অন দ্য ব্যাক ফুট’। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রযুক্তিগত দিক থেকে এগিয়ে থাকলেও মুখোমুখি কথা বলা, শরীরী ভাষা, কর্মক্ষেত্রের আদবকেতা কিংবা সামনাসামনি বসে দলের সঙ্গে কাজ করা—এ ধরনের কিছু দক্ষতায় জেন জিরা পিছিয়ে আছে। সত্যিই কি তাই?
তরুণদের নিয়ে নিয়মিত কাজ করেন জাভেদ পারভেজ। দেশের একটি নামী টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠানের এই মানবসম্পদ কর্মকর্তার কাছে আলোচনাটা তাই নতুন না। তিনি বলেন, ‘যখনই একটা নতুন প্রজন্ম কর্মস্থলে জায়গা করে নিতে গেছে, তখন কিন্তু পুরোনো প্রজন্মই নেতৃত্বে থাকে বা নিয়ন্ত্রণ করার পর্যায়ে থাকে। তাই শুরুতেই অনেকে বিচার করা শুরু করে। তারা এটা পারে না, ওটা শেখেনি, এভাবেই করতে হয় ইত্যাদি। এই দৃষ্টিভঙ্গি কোনো পক্ষকেই সাহায্য করে না।’ তিনি মনে করেন, এই প্রজন্মের পরিবর্তনটা খুব দ্রুত হয়েছে। করোনা না এলে এই পরিবর্তন আসতে হয়তো ১০-১৫ বছর লেগে যেত। যেহেতু পরিবর্তনের এই সময়ে নতুনেরাই সামনে নেতৃত্ব দেবে, তাই তাঁদের ওপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলে বা কোনো কিছু মানতে বাধ্য করলে সেটা টেকসই হবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন একাডেমিক জায়গা থেকে বিষয়টাকে মূল্যায়ন করেছেন। তাঁর মতে, ‘আগের প্রজন্ম থেকে নতুনেরা খুব এগিয়ে বা পিছিয়ে আছে বলে আমার মনে হয় না। প্রতিটি প্রজন্মই তো একটা স্বাভাবিক পরিবর্তনের মাধ্যমে আসে। এটাই নিয়ম। হয়তো ধরন বদলেছে। আগের প্রজন্ম যেভাবে করেছে, প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে ওরা আলাদাভাবে করছে। আগে যেমন চাকরির জন্য সিভি প্রিন্ট করে জমা দিতে হতো, এখন অনলাইনে পাঠালেই হয়। এমনকি সরাসরি লিংকডইন প্রোফাইল দিয়েও কাজ হয়ে যায়।’
চাকরির শুরুতে অনেক কিছুই শেখেন একজন তরুণ। অফিসের ক্যানটিনে খেতে খেতেও সহকর্মীর কাছ থেকে অনেক কিছু শেখা হয়ে যায়। কোন সিনিয়রকে কীভাবে একটা প্রস্তাব দিতে হয়, কোন স্বরে কথা বলা উচিত, মিটিংয়ে কোন চেয়ারে বসতে হয়, সব বিষয়েই ধারণা থাকা দরকার। মুখোমুখি যত সহজে সমস্যার সমাধান করা যায়, অনলাইনে কাজটা তত সহজ না-ও হতে পারে।
জাভেদ পারভেজের মতে, জেন জি-রা অনেক বিষয়কে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তনও আনতে চায় তাঁরা। তিনি বলছিলেন, ‘জেন জি-দের বেড়ে ওঠার সঙ্গী ছিল ইন্টারনেট, গুগল, ইলেকট্রনিক ডিভাইস। আমাকে একটা প্রশ্ন করলে আমি আমার অভিজ্ঞতায় খুঁজব কিংবা বইতে খুঁজব। তারা কিন্তু এলেক্সাকে বলবে, গুগলে সার্চ করবে। এটাই স্বাভাবিক। সহজ উপায় ছেড়ে কেন কঠিন পথে যাবে। তাদের জীবনযাপনটাও আমাদের মতো না। এগুলো কিন্তু প্রয়োজনের তাগিদেই তৈরি হয়েছে। সকাল নয়টায় অফিসে আসতে হবে, পাঁচটা পর্যন্ত থাকতেই হবে—ওরা এমনটা চায় না। ভাবে, কাজটা হলেই তো হলো। তাদের চাহিদাকে ছুড়ে ফেলার সুযোগ নেই। কর্মক্ষেত্রগুলোতেও পরিবর্তন আনতে হবে। আমাদেরই মানিয়ে নিতে হবে। অনেক প্রতিষ্ঠান হোম অফিস বা হাইব্রিড অফিস শুরু করেছে। এই সংস্কৃতি নিয়ে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা দরকার।’
এই জায়গাটায় অধ্যাপক মইনুল হোসেন অবশ্য পুরোপুরি একমত নন। তিনি বলেন, ‘শুধু মানিয়ে নিলেই চলবে না, তাঁদেরকে সঠিকভাবে বোঝানোটাও জরুরি৷ একজন কর্মীর শুধু কাজটা করলেই তো হলো না। তাহলে তো আমরা রোবট হয়ে যাব। কাজের সঙ্গে সামাজিক মিথস্ক্রিয়া, বোঝাপড়াও জরুরি।’
এখনকার সময়ে মানসিক স্বাস্থ্যকে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার বলে মনে করেন মইনুল হোসেন। তাঁর মতে, অনলাইনে সহানুভূতি দেখানোর সুযোগ কম। প্রযুক্তির চর্চার পাশাপাশি আমাদের আরও মানবিক হওয়ার চর্চাও করতে হবে।