বাইকে ৬ দিনে কলকাতা থেকে গোয়া

বাইকে ৬ দিনে কলকাতা থেকে গোয়া

৯ তরুণের একটি দল। কেউ চাকরি করেন, কেউ ব্যবসা, কেউ ছাত্র, কেউ আবার কনটেন্ট ক্রিয়েটর। পেশা কিংবা বয়স ভিন্ন হলেও একটা জায়গায় তাঁরা এক—সবাই মোটরসাইকেল চালাতে ভালোবাসেন। মজার ব্যাপার হলো, এই নয়জনের সবাই টিভিএসের অ্যাপাচি মডেলের মোটরসাইকেল চালান। অ্যাপাচি ওনার্স গ্রুপ (এওজি) নামের একটি ফেসবুক গ্রুপেরও তাঁরা সদস্য। সুযোগ পেলেই পছন্দের বাহনে চেপে ঘুরে বেড়ান সারা দেশ। তবে এবার তাঁদের গন্তব্য ছিল ভিনদেশ। ভারতের কলকাতা থেকে গোয়া মোটরসাইকেলে যাওয়া-আসা করেছেন তাঁরা। রোমাঞ্চকর এই যাত্রার আয়োজন করেছিল টিভিএস অটোস বাংলাদেশ।

এ বছরেরই ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে কলকাতা শহর থেকে শুরু হয়েছিল যাত্রা। আগের দিন সড়কপথে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পৌঁছান তাঁরা। আগেও মোটরসাইকেলে ভারতের বিভিন্ন শহরে ঘুরে বেরিয়েছেন দলের অন্যতম সদস্য কনটেন্ট ক্রিয়েটর সাইফুল্লাহ সানি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যিনি ‘সানিগিরি’ নামেই পরিচিত বেশি। কিন্তু এবারের যাত্রার আগের রাতে উত্তেজনায় ঘুম আসছিল না। উত্তেজনার কারণ টিভিএস মোটো সোল ২০২৩। গোয়া সৈকতে অনুষ্ঠেয় এই রেসে ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশের টিভিএস মোটরসাইকেল ব্যবহাকারীরা যোগ দেবেন।

সানি বলেন, ‘২৪ তারিখ ভোরে হোটেল থেকে বের হয়েই দেখি চকচকে নতুন নয়টি অ্যাপাচি আরটিআর ফোরভি বাইক দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। সোহেল নামের ভারতীয় এক বাইকার আমাদের বরণ করে নিলেন। তিনি আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন ওডিশার রৌরকেল্লায়। প্রায় সাড়ে ৪০০ কিলোমিটারের পথ। ভারতের মহাসড়কে বাইক চালানোর অভিজ্ঞতাই অন্য রকম। পথে পড়েছিল ঝাড়খন্ডের চমৎকার বনভূমি। সেখানে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম, ভিডিও বানালাম। তবে সুন্দরের প্রেমে পড়েই যেন পথ ভুল করলাম। তাই রৌরকেল্লার হোটেলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয়ে গেল।’

নেপাল থেকে আরেক দল

রৌরকেল্লায় তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন নেপালের ১১ বাইকার। পরদিন গোয়ার পথে বাঙালিদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লেন তারা। ভিন্ন দেশ, ভিন্ন ভাষা। তবে বাইকারদের যেন নিজস্ব এক ‘ভাষা’ আছে। সেই সূত্রে অল্প সময়ের মধ্যেই তিন দেশের বাইকারদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে গেল।

গল্প-আড্ডা আর ক্লান্তির কারণে পরদিন একটু দেরিতেই ঘুম ভেঙেছিল। এর পর থেকে সকালে আলসেমি করাই যেন অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়াল। সারা দিন বাইক চালিয়ে নতুন নতুন শহর। সন্ধ্যা থেকে সেই শহরে ঘোরাঘুরি আর পথের সঙ্গীদের সঙ্গে আড্ডার তালে কখন যে রাত গড়িয়ে যেত, কেউ টেরই পেত না। তাই প্রতিদিন সকালে একটু দেরিতে যাত্রা শুরু হতো। তবে তাও ১০টা থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যেই।

এভাবে মোটরসাইকেলে প্রতিদিন গড়ে ৪০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়েছেন ২১ বাইকার। সকালে সরণগড় তো সন্ধ্যায় গন্ডিয়া। পরদিন আবার গন্ডিয়া থেকে অমরাবতী। সেখানে রাত কাটিয়ে পরদিন সন্ধ্যায় আওরঙ্গবাদ। পথেই দুপুরের খাবার আর বিকেলের নাশতা। আর অসংখ্য চা-বিরতি। এওজি গ্রুপের সদস্য তৌহিদুজ্জামান জিয়া বলেন, ‘হাইওয়ে থেকে শুরু করে অনেক সরু রাস্তায় আমরা রাইড করেছি। আপ-ডাউন মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অ্যাপাচি বাইকের ব্যালেন্সড পারফরম্যান্স আর অসাধারণ মাইলেজ আমাদের পুরো পথচলাকে সহজ করে দিয়েছে।’

পুরো পথে বাইকারদের সঙ্গে ছিল তিনটি গাড়ি। ওই গাড়িতে ছিলেন মেকানিক, আলোকচিত্রী, ব্যাকআপ চালক আর ভ্রমণের যাবতীয় দিক সামাল দেওয়ার জন্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা। দুপুরের খাবারের সময় হলে ওই কর্মকর্তা গাড়ি নিয়ে কিছুটা পথে এগিয়ে যেতেন। ঘুরে ঘুরে রেস্তোরাঁ পছন্দ করতেন। এরপর বাইকারদের মুঠোফোনে পৌঁছে যেত ওই হোটেলের ঠিকানা।

বরযাত্রীর সঙ্গে কিছুক্ষণ

পথে যেতে যেতে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন বাইকাররা। মহারাষ্ট্রের সাতারায় পথে এক বরযাত্রীর বহরের সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল। ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে আসা বর, পাগড়ি পরা বরযাত্রী, সঙ্গে ব্যান্ডদলের বাজনা—সব মিলিয়ে যেন বলিউডের কোনো সিনেমার দৃশ্য। উত্তেজনা ধরে রাখতে না পেরে বাইকাররা থেমে বরযাত্রীদের সঙ্গে নাচানাচি শুরু করে। তাঁদের সঙ্গে বিয়েতে যাওয়ার জন্য বরযাত্রীরা জোরাজুরিও করেছিল। তবে বাইকারদের তাড়া থাকায় আর সে উপরোধ রাখা হয়নি। যাত্রাপথের বর্ণনা দিতে গিয়ে সানি বলেন, প্রতি এক শ কিলোমিটার পর পর যেন সংস্কৃতি-ভাষা বদলে যায়। আর প্রতিটি শহরের মানুষই অতিথিপরায়ণ। বিশেষ করে, দক্ষিণ ভারতের মানুষ খুবই অমায়িক।

অবশেষে ২ মার্চ সৈকতনগরী গোয়ায় পৌঁছে বাইকাররা। পরদিন ৩ মার্চ থেকে শুরু টিভিএস মোটো সোল ২০২৩। দুই দিনের এই উৎসবে ছিল মোটরসাইকেল স্টান্ট শো, বাইকারদের নিয়ে প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আর কনসার্ট।

ফেরার পালা

উৎসব শেষে ৫ মার্চ দিনভর উত্তর আর দক্ষিণ গোয়ার সৌন্দর্য উপভোগ করেছেন বাইকাররা। গোয়া পর্ব শেষ করে ৬ মার্চ শুরু হয় ফিরতি যাত্রা। তবে ফেরার রাস্তা ছিল পুরোপুরি ভিন্ন। ফেরার পথে আকর্ষণ ছিল মহীশূরে টিভিএসের কারখানা পরিদর্শন। এ ছাড়া সবাইকে মুগ্ধ করেছে মহীশূরের টিপু সুলতানের বিভিন্ন নিদর্শন আর স্থাপনা।

বাংলাদেশি বাইকারদের দলে ছিলেন আরেক কনটেন্ট ক্রিয়েটর নাভিদ ইশতিয়াক। ইউটিউবে তিনি ‘চকোলেট বাইকার’ নামেই পরিচিত। নাভিদের মতে, ফেরার পথের সব মুগ্ধতাকে ছাপিয়ে গেছে নেপালি বন্ধু অভিষেকের বাবা হওয়ার খবর। অভিষেক নেপালি বাইকারদের দলনেতা। নাভিদ বলেন, দেশে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে রেখে এসেছিলেন অভিষেক। তাই সব সময় পরিবার নিয়ে কিছুটা চিন্তায় থাকতেন। গোয়া থেকে ফেরার সময় কলকাতা থেকে কিছুটা দূরে থাকতেই তাঁরা খবর পেলেন, বাবা হয়েছেন অভিষেক। রাস্তায় মোটরসাইকেল থামিয়ে খবরটা উদ্‌যাপন করেছেন তাঁরা। পথের পাশের দোকান থেকে লাড্ডু কিনে খেয়েছেন। পরে কলকাতা ফিরে এ উপলক্ষে পার্টিও দিয়েছেন তাঁরা।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023 EU BANGLA NEWS