মাংসের চাটনি তৈরি করে দুবাইয়ে রপ্তানির জন্য ভারত থেকে এক টন মহিষের মাংস আমদানি করেছিল মেডলাইফ প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ১০ মে হিলি স্থলবন্দরে ওই মাংস এলেও এখনো ছাড় দেয়নি কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। মাংসের চালান ছাড় না দিতে কাস্টমসকে চিঠি দিয়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। তাদের যুক্তি, বিদেশ থেকে মাংস আমদানি করতে হলে আগে থেকে তাদের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হয়।
তবে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেডলাইফ বলছে, শিল্প খাতে ব্যবহারের জন্য মাংস আমদানির ক্ষেত্রে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অনুমতি নেওয়ার দরকার হয় না। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে তারা শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে, সাভারের ভাকুর্তায় কারখানা রয়েছে মেডলাইফ প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজের। তারা ১ টন মহিষ ও ২৫ টন পেঁয়াজ আমদানি করেছিল। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের আপত্তির কারণে ওই মাংস এখন কাস্টমসের তত্ত্বাবধানে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের একটি সংরক্ষণাগারে রয়েছে। আর পেঁয়াজ পড়ে আছে হিলি বন্দরের গুদামে।
এভাবে আমদানি করা মাংস আটকে দেওয়ার সমালোচনা করেছেন এই ব্যবসা–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, আগে মহিষের মাংস আমদানি করে বর্তমান বাজারমূল্যের চেয়ে বেশ কম দামে বিক্রি করতেন। কিন্তু আগে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অনুমতি বিধান করার পর তাঁরা মাংস আমদানি করতে পারছেন না। কারণ, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কাউকেই অনুমতি দিচ্ছে না।
গত বছরের এপ্রিলে আমদানি নীতি আদেশ ২০২১-২৪ জারি হয়। তাতে প্রথমবারের মতো গরু, ছাগল ও মুরগির মাংস ও মানুষের খাওয়ার উপযোগী অন্যান্য পশুর মাংস আমদানির ক্ষেত্রে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পূর্বানুমতির বিধান আসে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এরপর এক বছরে কোনো প্রতিষ্ঠানকেই মাংস আমদানির অনুমতি দেয়নি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। যদিও এই সময়ে সেখানে মাংস আমদানির ৩০টির বেশি আবেদন জমা পড়েছে বলে জানা গেছে। এসব আবেদনের বেশির ভাগই মহিষের মাংস আমদানির জন্য। আর বিভিন্ন তারকা হোটেলে সরবরাহের জন্য গরুর মাংস আমদানির কিছু আবেদনও রয়েছে।
কেন মাংস আমদানির কোনো আবেদনেই অনুমোদন দেওয়া হয় না, তা জানতে ১৭ মে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. এমদাদুল হক তালুকদারের দপ্তরে যান এই প্রতিবেদক। মহাপরিচালক তাঁর পক্ষে কথা বলার দায়িত্ব দেন অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মদ রেয়াজুল হককে।
রেয়াজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা প্রাণিসম্পদে স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশের প্রাণিসম্পদ শিল্পকে রক্ষা করতে আমরা মাংস আমদানিকে নিরুৎসাহিত করি। তারপরও আমদানির বিষয়টি অধিকতর যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়া চলমান আছে।’
তবে ভোক্তা ও মাংস আমদানি–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাঁদের মতে, বাজারে যেভাবে মাংসের দাম বেড়েছে, তাতে স্বল্প আয়ের মানুষের পক্ষে মাংস খাওয়াই কঠিন হয়ে পড়েছে। সেখানে আমদানি করা মাংস কম দামে পাওয়া গেলে তাতে মানুষ উপকৃত হবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তাও এই অভিমত জানিয়েছেন।
মাংস ছাড় না করতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর হিলি স্থল শুল্কস্টেশনকে চিঠি দেওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে তৎপর হয় তারা। হিলি স্থলবন্দর প্রাণিসম্পদ কোয়ারেন্টিন স্টেশনের ভারপ্রাপ্ত সহকারী পরিচালক কাজী মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আমদানি করা এই মাংসের কোয়ারেন্টিন সনদ লাগবে কি না, তা তাঁদের কাছে জানতে চায় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
জবাবে কাজী মাহবুবুর রহমান বলেন, অবশ্যই সনদ লাগবে। কারণ, মাংস ঠিক আছে কি না, রোগজীবাণু আসছে কি না—এ ধরনের কিছু পরীক্ষার পর সনদ দেওয়া হয়। কিন্তু দেখা যায়, মাংস আমদানির জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পূর্ব অনুমোদন লাগে, সেটাই নেই মেডলাইফের। সে কারণে কোয়ারেন্টিন সনদ দেওয়া যাচ্ছে না। মাহবুবুর রহমান বলেন, মাংস এখন কাস্টমসের জিম্মায় ঢাকায় সিলগালা অবস্থায় আছে। এক মাসের মধ্যে যদি এর সুরাহা না হয়, তাহলে বাংলাদেশ সরকার তার অনুকূলে নিয়ে যেকোনো কিছু করতে পারবে।
এ বিষয়ে নির্দেশনা চেয়ে আমদানি ও রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের দপ্তরে ১১ মে একটি চিঠি দেয় হিলি স্থল শুল্কস্টেশন। ১৬ মে হিলি স্থল শুল্কস্টেশনকে সেই চিঠির জবাব দেয় আমদানি ও রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের দপ্তর। তাতে আমদানি নীতি আদেশ ২০২১-২০২৪-এর শিল্প খাতে আমদানির ২০–এর (ক) ধারা এবং বাণিজ্যিক খাতে আমদানির ২৩–এর (৩৩) ধারা তুলে ধরে বলা হয়, ‘উল্লেখিত বিধানের আলোকে প্রতীয়মান হয় যে কোনো একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান তার নিজ প্রয়োজনে পোষক কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে নির্দিষ্ট পরিমাণ নিষিদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত পণ্য আমদানি করতে পারবে। বিষয়টি আপনার সদয় অবগতির জন্য নির্দেশক্রমে জানানো হলো।’
হিলি স্থল শুল্কস্টেশনের ডেপুটি কমিশনার অব কাস্টমস মো. বায়জিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আমদানি ও রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের দপ্তর দেশের আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে আমদানি পণ্য ছাড় করতে হয়। এই মাংসের বিষয়ে তারা যে নির্দেশনা দিয়েছে, তার আলোকে বলা যায়, ছাড় করতে বাধা নেই। বিডা ৪০টি আইটেম আমদানির অনুমতি দিয়েছে। মেডলাইফ এসব আনতে পারবে। ফলে মাংসের সঙ্গে যে ২৫ টন পেঁয়াজ এসেছিল, মনে হচ্ছে সেগুলো ছাড়তেও বাধা নেই।
বায়জিদ হোসেন বলেন, এখন তাঁদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আমদানি ও রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের দপ্তরে চিঠিটা পাঠাবেন। তারপর কর্তৃপক্ষ যেভাবে নির্দেশনা দেবে, সেভাবেই কাজ করবেন।
ভারতের কলকাতাভিত্তিক মেডলাইফ গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান মেডলাইফ প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, যা বিডার নিবন্ধন নেওয়া একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান। মেডলাইফ গ্রুপের পরিচালক ও মেডলাইফ প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিয়ন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ২০০২ সালে কলকাতায় মেডলাইফ গ্রুপ যাত্রা শুরু করে। তারা ভারত থেকে রপ্তানি করলে ভর্তুকি পায় না। অপর দিকে বাংলাদেশ সরকার রপ্তানিতে ভর্তুকি ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশে শ্রমিকের খরচ কম। সেই সঙ্গে দুবাইয়ের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের আগ্রহ, তারা যেন বাংলাদেশ থেকে মহিষের মাংসের আচার রপ্তানি করে। এসব কারণে বাংলাদেশের সব আইন মেনে বিডা থেকে নিবন্ধন নিয়ে ২০২২ সালে মেডলাইফ প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ গঠন করা হয়।
জিয়ন চৌধুরী বলেন, পরীক্ষামূলকভাবে মহিষের মাংসের আচার তৈরির জন্য এই এক টন মাংস আমদানি করা হয়েছে। তিনি বলেন, বিদেশি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় বিষয়টির সুরাহার জন্য তাঁরা ভারতীয় হাইকমিশনে যোগাযোগ করেছেন।
‘সবুজ বাংলা’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান ঢাকা, নারায়ণগঞ্জসহ কয়েকটি শহরে ভারত থেকে আমদানি করা মহিষের মাংস বিক্রি করত। মূলত খাবার হোটেলগুলোতে এসব মাংস সরবরাহ করত তারা। ওই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের একজন মাসুম চৌধুরী জানান, তাঁদের কোম্পানির মাংস আমদানির লাইসেন্স নেই। সে কারণে মহিষের মাংস আমদানির লাইসেন্স আছে, এমন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁরা ভারত থেকে মাংস আনতেন। ছয় মাস আগেও এমন একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে এক কনটেইনার বা ২৮ টন মহিষের মাংস আমদানির জন্য আবেদন করেন মাসুম চৌধুরী। কিন্তু অনুমতি মেলেনি।
মহিষের মাংস আমদানি করতে না পারায় সবুজ বাংলার ৩০টি শোরুম বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানান মাসুম চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন বেকার অবস্থায় আছি। আমার অনেক আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। আমার মতো এই খাতের ২০ হাজার মানুষ কর্ম হারিয়েছে।’
মাসুম চৌধুরী জানান, ২০২১ সালে তাঁরা সবশেষ এক কনটেইনার মহিষের মাংস আমদানি করেন। তখন বাংলাদেশের বাজারে ৩৭০ থেকে ৪২০ টাকা কেজি খুচরা বিক্রি করেছিলেন। তারপর আর আমদানির অনুমতি পাননি। তিনি বলেন, ‘এখন তো বাংলাদেশে ৭০০-৭৫০ টাকার নিচে মাংস নেই। সীমিত হলেও আমদানির অনুমতি দেওয়া প্রয়োজন। তাহলে এখন আমরা মহিষের মাংস ৫০০ টাকা কেজিতে খাওয়াতে পারব।’
দেশে দাম বাড়ায় অনেকেই মাংস খাওয়া কমিয়েছেন। রাজধানীর পূর্ব তেজতুরী বাজার এলাকায় থাকেন মো. রবিউল ইসলাম। তাঁরা তিন বন্ধু মিলে একটি বাসায় থাকেন। নিজেরাই রান্না করে খাওয়াদাওয়া করেন।
রবিউল ভ্রাম্যমাণ ভ্যানে করে ফল বিক্রি করেন। খরচ বাদ দিয়ে দিনে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা থাকে তাঁর। রবিউল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক দিনের আয় দিয়ে এক কেজি গরুর মাংস কেনা যায় না। ঈদের আগে একবার গরুর মাংস কিনেছিলাম, তারপর আর কিনিনি। দামের কারণে গরু, মহিষ, খাসি—এসব মাংস কেনা হয় না। যদি মাংসের পেছনে এত টাকা খরচ করি, গ্রামে পাঠাব কী, আর অন্যান্য খরচই–বা কীভাবে করব।’
দাম বাড়ার কারণে স্বল্প আয়ের মানুষের পক্ষে মাংস কেনা কঠিন হয়েছে, তা স্বীকার করেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেন, গরু, খাসি ও মহিষের মাংসের বাড়তি দামের কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। তা ছাড়া একটা শ্রেণি সিন্ডিকেটও করে রেখেছে। সে কারণে দাম আরও বেড়েছে। তাঁরা বলেন, বাজারে ভারসাম্য আনতে হলে অবাধে আমদানি না করে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ মাংস আমদানি করতে দেওয়া উচিত। তাহলে যাঁরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াচ্ছেন, সেটা ভেঙে যাবে। দেশের চাষিরাও ক্ষতির শিকার হবেন না। কিছু মাংস এলে দাম কিছুটা কমে ন্যায্য পর্যায়ে আসবে।