ভারত কি পাকিস্তানে হামলা চালাবে?

ভারত কি পাকিস্তানে হামলা চালাবে?

কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে বন্দুকধারীদের গুলিতে কমপক্ষে ২৬ জন পর্যটক নিহতের ঘটনায় ভারত ও পাকিস্তান সম্পর্কে চরম উত্তেজনা চলছে। মঙ্গলবারের ঘটনাকে ২০১৯ সালের পর থেকে সবচেয়ে মারাত্মক ‘জঙ্গি হামলা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে ভারত সরকার।এ হামলার জন্য কোনো তদন্ত ছাড়াই পাকিস্তানকে দায়ী করেছে দিল্লি। পাল্টা জবাবে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, পহেলগাঁও ঘটনাটি ভারতের সাজানো ছক। ঘটনা নিজে ঘটিয়ে দায় শত্রুর ওপর চাপানোর অপচেষ্টা মাত্র।   

এমন পরিস্থিতিতে ভারত কি পাকিস্তানে হামলা চালাবে? – উদ্বেগ অনেকের। উদ্বেগটা অনেক বেশি হওয়ার কারণ, ভারত-পাকিস্তান সংকটের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো, দুই পক্ষই পরমাণু শক্তিধর। এমন উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যেই বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) ভারতের নৌবাহিনী মিসাইল ধ্বংসের সফল পরীক্ষা চালিয়েছে।  

এছাড়া পহেলগাঁও ঘটনার পর পর দিল্লি নেওয়া দ্রুত কয়েকটি সিদ্ধান্ত যেন ভারতের ‘যুদ্ধংদেহী’ অবস্থানের ইঙ্গিত দিচ্ছে। প্রধান সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ করে দিয়েছে ভারত, একটি গুরুত্বপূর্ণ পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত করেছে। এছাড়া কূটনীতিকদের বহিষ্কারের মতো সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে।

পরিস্থিতিকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ ও উত্তপ্ত করেছে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের বক্তব্য। ‘কঠোর জবাব’ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। অপরাধীদের বিরুদ্ধেই নয়, ভারতের মাটিতে এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে থাকা ‘মাস্টারমাইন্ডদের’ বিরুদ্ধেও কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।

রাজনাথের এমন সব মন্তব্যের পর আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশেষজ্ঞদের মতে, এই মুহূর্তে প্রশ্ন এটা নয় যে সন্ত্রাসী হামলার জবাবে ভারতের পক্ষ থেকে সামরিক প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে কি না। প্রশ্ন হলো সেটা কখন হবে, তার মাত্রা কী হবে এবং তার ফলে কী মূল্য দিতে হতে পারে।

তবে পহেলগাঁও ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় আন্তঃসীমান্ত হামলা বা বিমান হামলার মতো ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সামরিক ইতিহাসবিদ শ্রীনাথ রাঘবন। বিবিসিকে তিনি বলেছেন, ‘আমরা সম্ভবত একটা দৃঢ় প্রতিক্রিয়া দেখতে পাব। ২০১৬ সাল থেকে বিশেষত ২০১৯ সালের পর থেকে এই জাতীয় ঘটনার ক্ষেত্রে প্রতিশোধমূলক যে ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, তা হলো আন্তঃসীমান্ত হামলা বা বিমান হামলা। কাজেই সরকারের পক্ষে এখন সেই মাত্রার নিচে কোনো কাজ করা কঠিন হয়ে পড়বে। অনুমান করা যায়, পাকিস্তানও আগের মতোই জবাব দেবে। এক্ষেত্রে বরাবরের মতোই যে ঝুঁকিটা থেকে যায় সেটা হলো, হিসাবে ভুল– যা উভয় পক্ষেরই হতে পারে। ’

পহেলগাঁওয়ে হামলার পর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিজেপি সমর্থকদের বিক্ষোভ।  ছবি: সংগৃহীত

পহেলগাঁওয়ে হামলার পর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিজেপি সমর্থকদের বিক্ষোভ। ছবি: সংগৃহীত

২০১৬ এবং ২০১৯ সালে ভারতের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দুটো বড় প্রতিক্রিয়া জানানো হয়। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে উরি (জম্মু ও কাশ্মীরের বারামুলা জেলায় অবস্থিত) হামলায় ১৯ জন ভারতীয় সেনার মৃত্যুর পর কার্যত নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে পাকিস্তানে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ করেছিল ভারত।

সেই সময় ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, তাদের লক্ষ্যবস্তু হলো পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীদের’ ঘাঁটি।

২০১৯ সালে পুলওয়ামা হামলায় আধাসামরিক বাহিনীর অন্তত ৪০ জনের মৃত্যুর পর পাকিস্তানের বালাকোটে অবস্থিত কথিত সশস্ত্র গোষ্ঠীর ঘাঁটিতে বিমান হামলা চালায় ভারত। ১৯৭১ সালের পর সেটাই ছিল প্রথম পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ভারতের বিমান হামলা। এর প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানও বিমান হামলা চালায়। বিবাদ বাড়তে থাকে। এই সময় ভারতীয় একজন পাইলটকে কয়েকদিনের জন্য আটকে রাখে পাকিস্তান। তবে দুই পক্ষই নিজেদের শক্তি দেখালেও তারা পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ এড়িয়ে যায়।

এর দুই বছর পর ২০২১ সালে নিয়ন্ত্রণ রেখায় ‘সিজ ফায়ার’ বা পরস্পরের সীমান্তে গুলি বন্ধ করতে সম্মত হয় ভারত ও পাকিস্তান। ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে বিভিন্ন সময় সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলা সত্ত্বেও কিন্তু এই শর্ত মূলত বহাল রয়েছে।

শ্রীনাথ রাঘবনের ধারণা, ‘পাকিস্তান পাল্টা জবাব দিতে পারে এবং তারপর সেখান থেকে সরে এসে আবার অন্য পথ অনুসরণ করতে পারে। যেমন দেখা যাচ্ছে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে। ইসরায়েল-ইরানসহ একাধিক ক্ষেত্রে আমরা এই একই ধারা লক্ষ্য করেছি। প্রথমে উত্তেজনা বৃদ্ধি এবং পরে তা প্রশমনের চেষ্টা। ’

পহেলগাঁওয়ে ২৬ বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের সামরিক প্রতিক্রিয়ার জোরালো সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয় বলে মন্তব্য পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যানের।  

তিনি বিবিসিকে বলেছেন, ‘ভারতের জন্য এই জাতীয় প্রতিক্রিয়ার প্রধান সুবিধা হবে রাজনৈতিক দিক থেকে। কারণ, জোরালো জবাব দেওয়ার জন্য তাদের ওপর ভারতীয় জনসাধারণের প্রবল চাপ থাকবে। আরেকটা সুবিধা হলো, যদি প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে সফলভাবে সন্ত্রাসী লক্ষ্যবস্তুকে নির্মূল করা সম্ভব হয়, তাহলে তা প্রতিরোধ ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠাসহ ভারতবিরোধী হুমকিকেও কমাতে পারে।  

তবে এ ক্ষেত্রে সংঘাতে জড়িয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে বলে জানান এ বিশ্লেষক।

যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অ্যাট অ্যালবানির ক্রিস্টোফার ক্ল্যারি মনে করেন, পহেলগাঁও ঘটনার পর প্রথমত ২০২১ সালে নিয়ন্ত্রণ রেখায় ‘সিজ ফায়ার’ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে পারে ভারত। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সীমান্তে আবার গুলি চালানোর জন্য সবুজ সংকেত দিতে পারেন। দ্বিতীয়ত, ২০১৯ সালের মতো বিমান হামলা বা এমনকি প্রচলিত ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর সম্ভাবনাকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না।  

কোনো পথই ঝুঁকিমুক্ত নয় জানালেন দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির এই গবেষক।

সেই ঝুঁকিরই ইঙ্গিত দিলেন যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুসেন হক্কানি। তিনি মনে করেন, ২০১৬ সালের মতো সীমিত পরিসরে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালানোর বিষয়ে যদি ভারত বিবেচনা করে তাহলে এবার উত্তেজনা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

আনোয়ার গারগাশ ডিপ্লোম্যাটিক একাডেমি ও হাডসন ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ ফেলো হুসেন হক্কানি বিবিসিকে বলেন, ‘ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে এ ধরনের হামলা চালানোর ক্ষেত্রে সুবিধা হলো এগুলোর পরিধি সীমিত। তাই পাকিস্তানকে এর জবাব দিতে হয় না। কিন্তু ভারতের জনসাধারণ দেখানো যায় যে তারা (ভারত) জবাব দিতে একটা পদক্ষেপ নিয়েছে। ’ 

এরপর তিনি বলেন, ‘তবে এই ধরনের হামলার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের পক্ষ থেকেও প্রতিক্রিয়া আসতে পারে। এক্ষেত্রে তারা যুক্তি দিতে পারে যে কোনো তদন্ত বা প্রমাণ ছাড়াই তাদের (পাকিস্তানকে) দোষারোপ করা হচ্ছে। ’

তবে ভারতকে আপাতত তাদের নিরাপত্তার ব্যর্থতার বিষয়টা বিবেচনা করতে হবে বলে মন্তব্য সামরিক ইতিহাসবিদ রাঘবনের। তিনি বলেন, পর্যটন মৌসুম যখন শীর্ষে তখন এই জাতীয় হামলা চালানো হয়েছে। এটা নিরাপত্তা ব্যবস্থার একটা গুরুতর ত্রুটি বা খামখেয়ালিপনার ইঙ্গিত করে। বিশেষত এমন একটা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল যেখানে কেন্দ্রীয় সরকার সরাসরি আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করে।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023 EU BANGLA NEWS