জীবন রক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালীকরণ এবং তামাকজাত পণ্যের কর ও মূল্য বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব হেলথ ইকোনোমিক্স শিক্ষার্থীরা।
মঙ্গলবার (২৯ অক্টোবর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের আয়োজনে এক সভায় এ দাবি জানান তারা।
বুধবার (৩০ অক্টোবর) কমিউনিকেশন্স অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের প্রজেক্ট অফিসার মো. তারেকুল ইসলাম সরকার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, তামাক আমাদের দেশের জন্য একটি মরণঘাতী সমস্যা। প্রতিদিন ৪৪২ জন মানুষ তামাক সেবনের কারণে মারা যাচ্ছে। আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে, যাতে তারা তামাক থেকে দূরে থাকতে পারে। তামাক কোম্পানির পরিচালনা পরিষদে বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অবস্থান খুবই হতাশাজনক। দেশকে তামাকমুক্ত করতে হলে সরকারকে শক্ত অবস্থান নিতে হবে সে সঙ্গে তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে।
স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক ড. শারমিন মবিন ভুইয়া বলেন, তামাক একটি বৈশ্বিক সংকট। আমরা সবাই জানি তামাক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, কিন্তু তারপরও আমরা দিনের পর দিন নিজেদের মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাচ্ছি তামাকপণ্যের ব্যবহারের ফলে। বাংলাদেশ তামাক নিয়ন্ত্রণ গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিটিসিআরএন) এর এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে আমাদের দেশে প্রতি ৫ জনের মধ্যে ১ জন তামাক ব্যবহার করে, যা জনস্বাস্থ্যকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। ২০১৯-২০২০ থেকে ২০২৩-২০২৪, অর্থবছরের সর্বস্তরের সিগারেটের প্যাকেটের দাম অল্প অল্প করে বাড়ানো হয়েছে। সিগারেটের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমাতে এক ধাক্কায় অনেকখানি করে দাম বাড়ানো দরকার। অল্প অল্প করে সিগারেটের দাম বাড়ালে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সঙ্গতি রাখা সম্ভব হয় না। তাতে সিগারেট বরং সহজলভ্য হয়ে ওঠে অন্যান্য পণ্যের তুলনায়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম বলেন, তামাকের ব্যবহার হৃদরোগ, ক্যানসার, শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন নন-কমিউনিকেবল রোগের অন্যতম কারণ। বাংলাদেশ সরকারকে তামাকপণ্যের ওপর কঠোর দৃষ্টি দিতে বাধ্য করার জন্য তরুণদের ভূমিকার কোনো বিকল্প নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের সব স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে তরুণদের নেতৃত্বে তামাকবিরোধী ক্লাব গঠন করে তামাকপণ্যের ব্যবহার এবং এর ক্ষতি সম্পর্কে তরুণদের সচেতন করতে হবে।
স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের প্রজেক্ট কো-অরডিনেটর ডা. ইফতেখার মুহসিন বলেন, তামাকপণ্যের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে আলোচনা করেন এবং তরুণ সমাজকে আহ্বান করে তামাকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মো. আতাউর রহমান বলেন, তামাকপণ্যের ব্যবহারে তরুণদের অনুপ্রাণিত করার জন্য বিভিন্ন তামাক কোম্পানি অনেক রকম আকর্ষণীয় ইভেন্টের আয়োজন করে যেমন, ব্যাটল অব মাইন্ডস, ক্যারিয়ার কার্নিভ্যাল ফর ইয়ুথ এবং আরও অন্যান্য। এসব তামাক কোম্পানি একটি বড় প্রতারণা করে তরুণদের চাকরি দেওয়ার নাম করে। প্রতি বছর বাংলাদেশে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ তামাকপণ্যে সেবনের ফলে মারা যাচ্ছে। এ ঘাটতি পূরণে তারা নিত্যনতুন কৌশল ব্যবহার করে নতুন ভোক্তা তৈরি করছে, মূলত তারা তরুণদের টার্গেট করে এ অপকৌশলগুলো চালাচ্ছে। তাই যত দ্রুত সম্ভব তামাকপণ্যের ওপর কর আরোপ করে দাম বাড়িয়ে তা তরুণ এবং সাধারণ মানুষের ক্রয় সীমানার বাইরে নিয়ে যেতে হবে। তাহলেই আগামী দিনে বাংলাদেশকে একটি তামাক মুক্ত দেশ এবং জাতি হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ডা. নিজাম উদ্দীন আহম্মেদ বলেন, সুস্থ-সমৃদ্ধ দেশের জন্য ধূমপানমুক্ত সমাজ দরকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুসারে, তামাক সেবনের ফলে প্রতিবছর ৮ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু ঘটে। এর মধ্যে সরাসরি তামাক ব্যবহারের কারণে মারা যায় ৭১ লাখ মানুষ এবং পরোক্ষ ধূমপানের কারণে মারা যায় প্রায় ৯ লাখ মানুষ। অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৩-১৫ বছরের শিশুদের মধ্যে (গ্লোবাল ইয়ুথ ট্যোবাকো সার্ভে-২০১৩)
৬.৯ শতাংশ কোনো না কোন ধরনের তামাক ব্যবহার করে, তাদের মধ্যে ছেলেদের সংখ্যা ৯.২ শতাংশ এবং মেয়েদের সংখ্যা শতকরা ২.৮ শতাংশ। আমাদের লক্ষ্যে হতে হবে এ শতকরার পরিমাণ শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা। বাংলাদেশে তামাকজাত পণ্যের আইন সংশোধন হলেও তরুণদের সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করতে হবে এ আইনের প্রয়োগ ঠিকমতো বাস্তবায়ন করে একটি সুস্থ এবং সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে।
স্বাস্থ্য অর্থনীতি স্টাডি অ্যালায়েন্স সভাপতি ইউসুফ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ বলেন, আজকে তরুণদের হাতে বাংলাদেশ। দেশের ৪৮ শতাংশ জনগোষ্ঠীই তরুণ এবং এসব তরুণের ৩৫ শতাংশ তামাকজাতপণ্যে আসক্ত যা জাতিগতভাবে আমাদের জন্য হুমকিস্বরূপ। তামাকের ক্ষতি থেকে জনস্বাস্থ্য রক্ষায় তরুণদের নেতৃত্বে গণসচেতনতা এবং গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আমরা আজ থেকেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই, তামাক সেবন করবো না এবং তামাকপণ্যের ব্যাবহারের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সব তরুণ এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দেবো।
এ সভার মধ্যে দিয়ে জীবন রক্ষায় তামাকবিরোধী আইন শক্তিশালীকরণ এবং তামাকজাত পণ্যের কর ও মূল্য বাড়ানোর জোর দাবি জানাই এবং তামাক বিরোধী কার্যক্রমকে সুদূঢ় করতে প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করে।
এ আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক ড. শারমিন মবিন ভুইয়া, পরিচালক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ডা. নিজাম উদ্দীন আহম্মেদ, নির্বাহী পরিচালক, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশন, চেয়ার, গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভাক্সিন অ্যান্ড ইমিউনাইজেসন (গ্যাভী) সহ বিভিন্ন পর্যায়ের বিশেষ ব্যক্তিরা।