গত এক সপ্তাহে দিনাজপুর সদর উপজেলা খাদ্যগুদাম থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় চাল সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩ হাজার ৯৪৪ টন। কিন্তু চলমান কারফিউতে পরিবহন-সংকটে সেখান থেকে কোনো চাল সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি। তবে কুষ্টিয়ায় বিজিবি, র্যাব ও পুলিশি পাহারায় ট্রাকের বিশাল বহরে ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ কয়েকটি জেলায় মঙ্গলবার চাল সরবরাহ করা হয়েছে।
দিনাজপুর সদর উপজেলা খাদ্যগুদামের সাধারণ ধারণক্ষমতা ৫ হাজার ৫০০ টন। মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত সেখানে চাল মজুত ছিল ৭ হাজার ৪০০ টন। স্থান সংকুলান না হওয়ায় একদিকে গুদামে আনা চালের ট্রাক ভর্তি অবস্থায় রয়েছে। অন্যদিকে উৎপাদনকৃত চাল নিয়ে বিপাকে পড়েছেন মিলমালিকেরাও।
মঙ্গলবার দুপুরে দিনাজপুর সদর উপজেলা খাদ্যগুদাম ঘুরে দেখা যায়, অন্তত ২০টি চালের ট্রাক লোড অবস্থায় গুদামঘরের সামনে সারিবদ্ধ অবস্থায় দাঁড়ানো। অলস সময় কাটাচ্ছেন গুদামের শ্রমিকেরা। গুদামরক্ষক ভবতোষ বিশ্বাস জানান, এ জেলা থেকে ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কাপ্তাই, বান্দরবানসহ বিভিন্ন জেলায় চাল পাঠানো হয়। চলমান পরিস্থিতিতে পরিবহন ঠিকাদারেরা গাড়ি বের করছেন না। কয়েকজন পরিবহনমালিককে বোঝানোর পর গতকাল ১৭ ট্রাক চাল পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়।
দিনাজপুর শহরের পুলহাট এলাকায় বাঁধন অয়ন অটোরাইস মিলের স্বত্বাধিকারী রফিকুল ইসলাম বলেন বলেন, ‘চলমান পরিস্থিতিতে আমরা চাল উৎপাদন বন্ধ রাখি নাই, কিন্তু সরবরাহ তো করতে পারছি না। গুদামঘরেও জায়গা নাই। সরকারি গুদামে চাল সরবরাহ করতে না পারায় বিলও পাচ্ছি না। ব্যাংক বন্ধ থাকায় লেনদেনও করা যাচ্ছে না। চাল পাঠানোয় কোনো ট্রাকমালিক রাজি হলেও ভাড়া চাচ্ছেন বেশি।’
তবে চাল সরবরাহ বিষয়ে জটিলতা থাকলেও দিনাজপুরে গত সাত দিনে চালের বাজারে কোনো প্রভাব পড়েনি। দিনাজপুর বাহাদুর বাজারে (চালের বাজার) ঘুরে দেখা যায়, পাইকারিতে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৫০ থেকে ৩ হাজার ২৫০ টাকা, স্বর্ণ প্রতি বস্তা ২ হাজার ৬০০ টাকা থেকে ২ হাজার ৬৫০ টাকা, ২৯ জাতের চাল ২ হাজার ৭০০ থেকে ২ হাজার ৭৫০ টাকা, নাজিরশাইল ও বাসমতী চাল প্রতি বস্তা (২৫ কেজি) ২ হাজার থেকে ২ হাজার ১০০ টাকা পর্যন্ত।
বাংলাদেশ অটো মেজর রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি সহিদুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, পরিবহন-সংকটে মিলমালিকেরা চাল সরবরাহ করতে কিছুটা সমস্যায় পড়েছেন। তবে এই সাত দিনে কোনো জায়গায় চালের সংকটের কথা শোনা যায়নি। হয়তো দু-এক দিনের মধ্যে সমস্যা কেটে যাবে।
পাহারায় চাল গেল ঢাকায়
কুষ্টিয়ার খাজানগর মোকামে চালের উত্পাদন স্বাভাবিক থাকলেও পরিবহনের সমস্যায় সরবরাহ প্রায় বন্ধ ছিল। পাঁচ দিন পর মঙ্গলবার দুপুরে বিজিবি, র্যাব ও পুলিশি পাহারায় চালের শতাধিক ট্রাক ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার উদ্দেশে রওনা দেয়। দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটের দিকে শহরের বটতৈল এলাকা থেকে ট্রাকের দীর্ঘ সারি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাড়ির পাহারায় ছেড়ে যায়। এ সময় সেখানে জেলা প্রশাসক মো. এহেতেশাম রেজা, পুলিশ সুপার মুহাম্মদ আলমগীর হোসেন, কুষ্টিয়া চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু জাফর, খাজানগর এলাকার দেশ অ্যাগ্রো ফুড লিমিটেডের মালিক এম এ খালেক, ফ্রেশ অ্যাগ্রো ফুড লিমিটেডের মালিক ওমর ফারুকসহ কয়েকজন মিলমালিক উপস্থিত ছিলেন।
মিলমালিকেরা জানান, জেলায় ৬৬টি অটোরাইস মিলসহ ৪০২টি হাসকিং মিল রয়েছে। ৯০ শতাংশ মিল রয়েছে খাজানগর এলাকায়। দেশের অস্বাভাবিক পরিস্থিতির কারণে পাঁচ দিন ধরে তাঁরা চাল উত্পাদন স্বাভাবিক রাখতে পারলেও সরবরাহ করতে পারছিলেন না। এমনকি ধান কিনেও মোকামে আনতে পারছেন না।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকাসহ দেশের বড় জেলাগুলোয় চালের যে চাহিদা, তার বড় অংশ সরবরাহ করা হয় কুষ্টিয়ার খাজানগর মোকাম থেকে। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে দেশজুড়ে সহিংসতা ও এর পরিপ্রেক্ষিতে কারফিউ জারির ফলে চাল পরিবহনে সমস্যা দেখা দেয়। বিষয়টি নিয়ে মিলমালিকেরা গত রোববার জেলা প্রশাসকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। জেলা প্রশাসক তাঁদের আশ্বাস দেন, একসঙ্গে গাড়ি যেতে পারলে তাঁদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাড়ি স্কট দেওয়া হবে।
জেলা প্রশাসক মো. এহেতেশাম রেজা প্রথম আলোকে বলেন, ১০৩টি গাড়ির তালিকা পাওয়া গেছে। বেশির ভাগ গাড়ি পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা যায়। কুষ্টিয়ার শেষ সীমানা পর্যন্ত গিয়ে রাজবাড়ী জেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চালের ট্রাকের বহরে নিরাপত্তা দেয়। এরপর ঢাকাসহ যেসব জেলার আওতায় পড়েছে, সেসব জেলা নিরাপত্তা দেয়। চাল সরবরাহে কোনো সমস্যা হয়নি।