আগামী ২১ জুন সিলেট সিটি কর্পোরেশন (সিসিক) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নগরীতে ভোটার-প্রার্থীদের নানামুখী তৎপরতা শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে নির্বাচনী বাহাসও শুরু হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ নেতারা আনোয়ারুজ্জামান চৌধূরীর বিজয় নিশ্চিত করতে বর্তমান সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধূরীর বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকা লুটপাট ও অপরিকল্পিত নগর উন্নয়নের অভিযোগ এনেছেন। অন্যদিকে মেয়রের কাঁধে রয়েছে নিজ দল বিএনপি থেকে বহিষ্কারের খড়গ। এতকিছুর চাপ সামলিয়ে মেয়র আরিফ কি নির্বাচন আসছেন; সে আগ্রহ জনমনে।
আরিফুল হক আওয়ামী লীগের অভিযোগ খণ্ডন করে বলেছেন, ‘আমার কাজের প্রশংসা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তাছাড়া সেই বিচারের ভার জনগণের উপরই রইল।’
তবে মেয়র আরিফুল হক চৌধূরী প্রার্থী হওয়া বিষয়টি এখনো ‘খোলাসা’ হয়নি। কিন্তু তিনি সিসিক নির্বাচনে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট অনুষ্ঠানের বিষয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করে রহস্য আরো গাড় হচ্ছে।’
শুক্রবার (২৮ এপ্রিল) সিসিক’র বর্ধিত এলাকা কুচাই এর একটি মসজিদে জুমার নামাজের পর মুসল্লিদের সাথে আলোচনার পর মেয়র আরিফ বলেন, ‘ইভিএম পদ্ধতির সাথে সিলেটের সাধারণ মানুষের পরিচিতি নেই। ভোটাররা কাঙ্ক্ষিত সুফল পাবেন না।’
তিনি বলেন, ‘সরকারের সদিচ্ছা থাকলে, ইভিএম পদ্ধতি নিয়ে আরো আগে থেকেই কর্মশালা করা যেত।’
সিসিক নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সিলেটের মুরব্বিসহ সব শ্রেনীর মানুষের সাথে আলোচনা করেই শিগগির সিদ্ধান্ত জানাবো।’
অন্যদিকে, ইসি সিসিক নির্বাচনের প্রস্তুতি ও স্বরূপ গত বুধবার সিসিক নির্বচনের জন্য একজন রিটার্নিং কর্মকর্তা ও ১৪ জন সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে। নিয়োগ প্রাপ্তরা সিলেটের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। ইসি এরমধ্যে সব ধরণের প্রচার সামগ্রী প্রার্থীদের নিজ উদ্যোগে সরিয়ে নিতে নির্দেশনা দিয়েছে। নির্দেশনা পালন না হলে, বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও হুশিয়ারি দিয়েছে।
মেয়র প্রার্থী নিয়ে কৌতূহলের দানা ঘন হচ্ছে, যুক্তরাজ্যে সিলেটের অধিবাসীদের মধ্যে আলোচনার ঝড়
বর্তমান সরকারের অধীনে কোন নির্বাচনে যাবে না বিএনপি- এমন সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে আরিফুল হক সিসিক নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন কিনা সেই ধোঁয়াশা এখনো কাটেনি। বিএনপি-আওয়ামী লীগ থেকে বিদ্রোহী ও জাতীয় পার্টি থেকে সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থীদের নাম আলোচিত হলেও তারাও কোন ঘোষণা দেননি।
এমনকি গত বৃহস্পতিবার থেকে মনোনয়নপত্র বিক্রয় শুরু হলেও কেউ ক্রয় করেননি। সব মিলিয়ে প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেটে সিসিক নির্বাচন নিয়ে কৌতূহল দানা বাধছে। অন্যদিকে প্রবাসে বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে বসবাসরত সিলেটের অধিবাসীদের মধ্যে আলোচনার ঝড় শুরু হয়েছে সিসিক নির্বাচন নিয়ে। সেখানকার বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে, ফেসবুকে আলোচনা হচ্ছে সিসিক নির্বাচকে কেন্দ্র করে। কারণ সেখানে মেয়র প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামানের যেমন পরিচিতি তেমন পরিচিতি বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধূরীরও।
একজন রিটার্নিং কর্মকর্তা ও ১৪ জন সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ
সিসিক নির্বাচনে একজন রিটার্নিং কর্মকর্তা এবং ১৪ জন সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাকে গত বুধবার নিয়োগ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
সূত্র জানায়, সিলেটের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ফয়সল কাদেরকে সিসিক নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
সহকারী নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে একজন অতিরিক্ত আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা, পাঁচজন জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও ৮ জন উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। তফসীল ঘোষণার পর থেকেই নগর থেকে সব ধরণের প্রচার সামগ্রী অপসারণের ঘোষণা দিয়েছে ইসি।
নির্বাচনী তীর আরিফের দিকে
যদিও যুক্তরাজ্য আওয়ামীলীগ নেতা আনোয়ারুজ্জামান চৌধূরী নির্বাচনী প্রচারণা জোরে-শোরে চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু বিএনপি বা অন্য কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীর নাম ঘোষিত হয়নি। তাই তিনি এখনো এক তরফা মাঠ দাপিয়ে চলছেন। অবশ্য তার দল ও সমর্থকরা বর্তমান মেয়র বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধূরীকেই প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে মাঠে কাজ করছেন এবং তাকেই প্রধান প্রতিপক্ষ ভেবে নির্বাচনী তীর নিক্ষেপও শুরু হয়েছে।
নগর উন্নয়নে আরিফুল হকের বিরুদ্ধে আলোচনা-সমালোচনা ও তির্যক মন্তব্য
গত ১০ বছর ধরে সিলেট সিটি কর্পোরেশেনর মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী লুটপাট চালিয়েছেন- এমন অভিযোগ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের।
বৃহস্পতিবার রাতে শহরের তালতলার একটি রেস্তোরাঁয় মহানগর আওয়ামী লীগের জরুরি সভায় সভাপতির বক্তৃতায় মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাসুক উদ্দিন আহমদ মেয়র আরিফুল হকের সমালোচনা করে বলেন, ‘সরকার সিলেটে প্রচুর টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের ছিটেফোঁটাও হয়নি, বরং মেয়রের নেতৃত্বে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। জন দুর্ভোগ বেড়েছে। সিলেট মহানগরের জলাবদ্ধতা, ড্রেনেজ সমস্যা, শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ, রাস্তাঘাট সম্প্রসারণসহ পরিকল্পিত নগরায়ণের স্বার্থে এবং নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হলে নগরভবনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নিশ্চিত করা জরুরি।’
এ অবস্থা থেকে উত্তরণে নৌকার বিজয় নিশ্চিত করতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সিসিক নির্বাচনে অপর ৯ আওয়ামী লীগ নেতা দলীয় মনোনয়ন লাভের দৌড়ে ছিলেন। কিন্তু মনোনয়ন লাভে বঞ্চিত হয়ে তারা অনেকটা চুপচাপ। নেতৃবৃন্দ নৌকা প্রতীককে জয়লাভ করতে দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ঐক্য আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
আরিফুল হক বসে নেই
এদিকে আরিফুল হকও বসে নেই। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের পাল্টা জবাবও দিয়েছেন। এতে সঙ্গত ভাবেই ‘নির্বাচনের পালে হাওয়া’ বইতে শুরু করেছে।
মেয়র আরিফ এমন সমালোচনার জবাবে বলেন, ‘গত বন্যার সময় সিলেটে এসে সার্কিট হাউসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেখানেই এর উত্তর আছে। প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতায় আমার কাজের প্রশংসা করেছিলেন।’
অপরিকল্পিত উন্নয়নের অভিযোগ সম্পর্কে মেয়র বলেন, ‘উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সরকারের চারটা মন্ত্রণালয় খতিয়ে দেখে। এসব দেখে বিচার-বিশ্লেষণ করেই বরাদ্দ দিয়ে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীও এসবের অনুমোদন দেন। তাই এত এত মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-সচিব ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা যা দেখে অনুমোদন দিয়ে থাকেন, সেসব অপরিকল্পিত হয় কীভাবে?’
তিনি বলেন, জনগণের আকাঙ্ক্ষা কতটুকু পূরণ করতে পেরেছি- এর বিচারের ভার জনগণের কাছেই রইল।
‘আরিফুল হক চৌধুরী ও বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিয়ে জনগণের প্রতি সম্মান জানাবেন’
আরিফুল হক ও তার দল বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিয়ে জনগণের প্রতি সম্মান জানাবেন- এমনই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী।
মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী নির্বাচনে এলেও নৌকার জয় নিশ্চিত হবে এমন মন্তব্য আনোয়ারুজ্জামানের। তিনি বলেন, ‘এবারের নির্বাচনে সিলেটবাসী মেয়র পদে পরিবর্তন চান।’
আনোয়ারুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ‘মেয়র আরিফুল হককে সরকার ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। উনি কাজ করেননি, তা আমি বলব না। উনি চেষ্টা করেছেন- উনি যে কাজটা করেছেন, কসমেটিকস উন্নয়ন হয়েছে। পরিকল্পিত উন্নয়ন হয়নি।’
আনোয়রুজ্জামান বলেন, ‘তিনি নির্বাচিত হলে মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে পরিকল্পিত উন্নয়ন করবেন।’
গুঞ্জন
বিএনপি সিটি নির্বাচনে না আসার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই নগরে গুঞ্জন রয়েছে, মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। যদিও এ বিষয়ে আরিফুল এখনো বিষয়টি খোলাসা করেননি।
এদিকে বিএনপির হাইকমান্ড থেকে বলা হয়েছে সিটি নির্বাচনে বিএনপির নেতা-কর্মীরা অংশগ্রহণ করলে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে। সে ব্যাপারে মেয়র আরিফের এখনো কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।