ঢাকাই সিনেমার শক্তিমান এক নাম ওয়াসিম। ৭০ ও ৮০ দশকের একজন জনপ্রিয় অভিনেতা।নায়ক হিসেবে তার ছিল দুর্দান্ত সাফল্য।
কালজয়ী এই অভিনেতা ১৯৫০ সালের আজকের দিনে (২৩ মার্চ) চাঁদপুরের মতলবে জন্মগ্রহণ করেন। আর ২০২১ সালের ১৭ এপ্রিল দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর।
বর্তমান প্রজন্মের প্রায় সব নায়কদের কাছে পর্দায় নিজেকে আকর্ষণীয় করে তুলতে বডি বিল্ডিং খুবই পছন্দের বিষয়। সিনেমায় কাজ শুরু করার পর নিজের সুঠাম দেহের জন্য অনেককে দিনের বেশিরভাগ সময় পার করতে দেখা যায় জিমে। কিন্তু চিত্রনায়ক ওয়াসিমের ক্ষেত্রে বিষয়টি ছিল ভিন্ন।
সিনেমায় আসার আগেই তিনি ছিলেন বডি বিল্ডিংয়ে চ্যাম্পিয়ন। ১৯৬৪ সালে বডি বিল্ডিংয়ের জন্য তিনি ‘মিস্টার ইস্ট পাকিস্তান’ খেতাব অর্জন করেছিলেন।
ওয়াসিম বডি বিল্ডিং শুরু করেন পাকিস্তান আমলে, যখন তিনি কলেজ ছাত্র। পরবর্তীতে বন্ধুদের অনুপ্রেরণায় বডি বিল্ডিং প্রতিযোগিতায় নাম লিখিয়ে সাফল্য পান তিনি। শুধু তাই নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ. পাস করেছেন তিনি।
ওয়াসিমের প্রকৃত নাম মেজবাহ উদ্দিন। তবে সিনেমায় সবাই তাকে ওয়াসিম নামেই চিনতেন। রূপালি পর্দায় অভিনয় শুরু আগে মেজবাহ উদ্দিন নামেই পরিচিত ছিলেন তিনি।
মহসিন পরিচালিত ‘রাতের পর দিন’ ওয়াসিম অভিনীত প্রথম সিনেমা হলেও ১৯৭২ সালে এস এম সফি পরিচালিত ‘ছন্দ হারিয়ে গেল প্রথম’ প্রথম প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। প্রথম সিনেমার পর ওয়াসিমের খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সত্তর দশকে পোশাকি, ফোক, ফ্যান্টাসি সিনেমার সুপার ডুপার হিট নায়ক তিনি।
১৯৭৬ সালে মুক্তি পাওয়া এস এম শফী পরিচালিত ‘দি রেইন’ সিনেমা ওয়াসিমকে ব্যাপক খ্যাতি এনে দেয়। তিনি হয়ে ওঠে জনমানুষের নায়ক। সিনেমাটি এতই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে বিশ্বের ৪৬টি দেশে সেটি মুক্তি পেয়েছিল। ১৯৭৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত চলচ্চিত্রে শীর্ষ নায়কদের একজন ছিলেন তিনি।
ওয়াসিম অভিনীত উল্লেখযোগ্য সিনেমার মধ্যে রয়েছে ‘ডাকু মনসুর’, ‘দ্য রেইন’ ‘জিঘাংসা’, ‘কে আসল কে নকল’, ‘বাহাদুর’, ‘দোস্ত দুশমন’, ‘মানসী’, ‘দুই রাজকুমার’, ‘সওদাগর’, ‘নরম গরম’, ‘ইমান’, ‘রাজ দুলারী’, ‘লুটেরা’, ‘লাল মেম সাহেব’, ‘বিনি সুতার মালা’ ইত্যাদি।
পর্দায় অলিভিয়া, অঞ্জু ঘোষ, শাবানা ও অঞ্জনার সঙ্গে ওয়াসিমকে বেশিভাগর জুটি বাঁধতে দেখা গেছে। ‘দি রেইন’ সিনেমায় এই তার নায়িকা ছিলেন অলিভিয়া। এরপর ‘বাহাদুর’, ‘লুটেরা’, ‘লাল মেম সাহেব’, ‘বেদ্বীন’ সিনেমায় অলিভিয়ার পর্দা ভাগ করেছেন তিনি। ‘রাজ দুলালী’ সিনেমায় শাবানার সঙ্গে জুটি বেঁধে দারুণ সাফল্য পান তিনি।
এছাড়া অঞ্জু ঘোষের সঙ্গে ওয়াসিম অভিনয় করেছেন ‘সওদাগর’, ‘নরম গরম’, ‘আবেহায়াত’, ‘চন্দনদ্বীপের রাজকন্যা’, ‘পদ্মাবতী’, ‘রসের বাইদানী’সহ বেশকিছু সিনেমায়। অঞ্জনার সঙ্গে তাকে দেখা গেছে ‘প্রেমের সমাধি’, ‘ঈমানদার’, ‘দিদার’, ‘ডাকু ও দরবেশ’, ‘জুলুমের বদলা’, ‘সংঘাত’সহ বেশকিছু সিনেমায়।
১৯৭৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ঢাকাই সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে ওয়াসিম ছিলেন শীর্ষ নায়কদের একজন। সাহসী নায়ক বলা হতো তাকে। টানা ৬০টিরও বেশি সুপারহিট সিনেমা উপহার দিয়েছেন তিনি যা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
তবে এক ক্ষোভ নিয়েই চিরতরে চলে গেছেন ওয়াসিম। এক গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ওয়াসিম জানিয়েছিলেন, চলচ্চিত্র জীবনে তার কোনো অপ্রাপ্তি নেই। অর্থ, যশ, খ্যাতি সবই পেয়েছেন। তবে তার একটি ক্ষোভ আছে। সেটি হলো ১৯৭৯ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার নাম বাদ দিয়ে অন্যান্য সবার নাম ঘোষণা করে পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল।
ওয়াসিমের দাবি, ‘ইমান’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য তাকে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কুচক্রী মহলের ষড়যন্ত্রে তাকে বাদ দেওয়া হয়। সেই ক্ষোভের বেদনা বয়ে বেড়িয়েছেন তিনি আমৃত্যু।
তবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার না পেলেও এ অভিনেতা নিজেকে অধিষ্ঠিত করেছিলেন সুপারস্টারের আসনে। ক্যারিয়ারে দেড় শতাধিক সিনেমা করেছেন, যার মধ্যে ৯০ শতাংশই সুপারহিট। সে সঙ্গে কোটি মানুষের ভালোবাসা তিনি অর্জন করেছেন।