ঈদের দিনের একটা দৃশ্য দিয়ে শুরু করি। শনিবার, বেলা পৌনে তিনটা। মতিঝিলের মধুমিতা সিনেমা হলের সামনে পৌঁছেই শুনছিলাম হাঁকডাক, ‘এই ডিসি রিয়াল, ডিসি রিয়াল…।’ রিকশা থেকে কাউকে নামতে দেখলেই এগিয়ে যাচ্ছেন একাধিক টিকিট বিক্রেতা। সিনেমা দেখতে আসা দর্শকের বিশাল সারি আর কালোবাজারে টিকিট বিক্রি কিংবা প্রিয় তারকার পোস্টার পাশে রেখে সেলফি—এমন বিরল দৃশ্য বহুদিন পর দেখা গেল সিনেমা হলের সামনে। ছবি দেখার আগ্রহ স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে গেল।
সারা দেশের ১০০ হলে চলছে তরুণ নির্মাতা তপু খান পরিচালিত শাকিব-বুবলীর ‘লিডার: আমিই বাংলাদেশ’। গত সোমবার দুপুরে মধুমিতার রিয়াল স্টলের একদম পেছনের সারিতে বসে দেখে ফেললাম ছবিটি। দুপুর সাড়ে ১২টার এই শোতে বেশ কিছু আসন খালি ছিল বটে। কিন্তু ২ ঘণ্টা ২৪ মিনিটের ছবিটির শেষে দর্শকদের অভিব্যক্তি ছিল তৃপ্তির, অনেকেই বলেছেন দারুণ ছবি!
চেনা গল্প। তবে গল্পের উপস্থাপন, পরিবেশনায় আছে আধুনিকতা ও অভিনবত্ব। পোশাক, দৃশ্য, মেকআপ, সেট দেখে মনে হয়েছে, আরে, এ তো আমাদের দেশের চিরাচরিত বাণিজ্যিক ছবি! এককথায় ‘লিডার: আমিই বাংলাদেশ’ ছবির এটাই নির্যাস।
‘চেনা গল্প’ কথাটি পড়ে যাঁরা ধরে নিয়েছেন, গল্পের বিষয় ধনীর আদুরে কন্যা, গরিবের প্রতিবাদী পুত্রের ঝগড়া, প্রেম আর বিয়ে নিয়ে এ ছবি—তাঁরা ভুল ভাবছেন। বিষয়টি অনেকটা এমন, আপনার প্রিয় দলের পুরোনো খেলোয়াড়েরাই মাঠে নেমেছে, কিন্তু খেলছে একেবারে ভিন্ন পদ্ধতিতে, যা আপনার ধারণার মধ্যেই নেই। এখানেই এ ছবির চমক।
সিনেমার শুরুতে চমক। সিনেমার নায়ক নাফিস ইকবালের উপস্থিতিতে দর্শকের করতালি বলে দেয়, প্রিয় নায়কের ‘লুক’ তাঁদের পছন্দ হয়েছে। শুরুতেই গান। ‘কথা আছে’ শিরোনামের গানটি গেয়েছেন ‘গালি বয় রানা’ দিয়ে পরিচিত তাবিব মাহমুদ। র্যাপ ঘরানার ‘কথা আছে কথা আছে, আমার কিছু কথা আছে’ গানটি বলে দেয় কী গল্প বলতে চাইছেন পরিচালক।
গল্পের প্রেক্ষাপট শহরের কোনো এক এলাকা, যেখানে ন্যূনতম নাগরিক সুবিধা নেই। এবড়োখেবড়ো রাস্তা ঠিক করার আশ্বাস দিয়েও কাউন্সিলর হতাশ করে জনগণকে। এ এলাকার তরুণ নাফিস ইকবাল চাকরি ছেড়ে এলাকায় কফিশপ চালায়। সে মনে করে, তরুণেরাই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, সরকারের দিকে না তাকিয়ে থেকে নিজেদের কাজ নিজেদের করেই এগিয়ে যেতে হবে। অন্যদিকে শহরের নামকরা চিকিৎসকের মেয়ে মিলার স্বভাব এর বিপরীত। সে ক্ষমতাপিপাসু। বিপরীত স্বভাবের মিলা ও নাফিস ‘ঢালিউড’ ফর্মুলায় প্রেমে পড়ে।
সিনেমার শুরুতে চমক। সিনেমার নায়ক নাফিস ইকবালের উপস্থিতিতে দর্শকের করতালি বলে দেয়, প্রিয় নায়কের ‘লুক’ তাঁদের পছন্দ হয়েছে। শুরুতেই গান। ‘কথা আছে’ শিরোনামের গানটি গেয়েছেন ‘গালি বয় রানা’ দিয়ে পরিচিত তাবিব মাহমুদ। র্যাপ ঘরানার ‘কথা আছে কথা আছে, আমার কিছু কথা আছে’ গানটি বলে দেয় কী গল্প বলতে চাইছেন পরিচালক। বিরতির আগে পরিচালক মোটামুটি সব চরিত্র প্রতিষ্ঠিত করে গল্পের ভিতটা মজবুত করার চেষ্টা করেন। বিরতির পর ক্লাইম্যাক্সের শুরু।
শাকিব-বুবলীকে জুটি হিসেবে পর্দায় দেখতে খারাপ লাগেনি এক মুহূর্তের জন্য। আদর্শবান পিতার যোগ্য সন্তানের সত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় লড়াই করা তরুণের মাধ্যমে এমন কিছু বলা হয়েছে, যা আগে বলা হয়নি। যেমন এলাকার রাস্তা ঠিক করার জন্য কাউন্সিলরের জন্য বসে না থেকে নিজেরাই এগিয়ে গেলেও কাজটা হয়ে যেতে পারে। নিজেরা এগিয়ে গেলে সবার চাওয়া পূর্ণ হয়।
এবার বছরখানেক পর শাকিব খান তাঁর চেনা মাঠে ফিরেছেন, চালিয়ে ব্যাটিংও করেছেন। অন্যদিকে বুবলীকে মাঝেমধ্যে মনে হয়েছে, অভিনয় করছেন; যেমন খুশি তেমন সাজোতে ‘নেত্রী’ সেজেছেন। গানে কিংবা রোমান্টিক দৃশ্যে পর্দায় তাঁকে যতটা ভালো লেগেছে; ছাত্রনেত্রী হিসেবে সংলাপ প্রক্ষেপণের সময় তা আরোপিত মনে হয়েছে।
মিশা সওদাগর এখানেও খলনায়ক, তবে তাঁকে নতুন লেগেছে। প্রমাণ করেছেন, চিৎকার না করেও বাণিজ্যিক ঢাকাই ছবির ভিলেন হওয়া যায়! নায়িকার বাবার চরিত্রে সুব্রত ও নায়কের বাবার চরিত্রে ফাখরুল বাশারের অভিনয় আর পাঁচটা পরিবারের বাবার যাপিত জীবনের কথা মনে করায়। ‘লিডার: আমিই বাংলাদেশ’–এ আরেকটি ভালো বিষয় ছিল ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয়শিল্পীদের অভিনয়। সবাই সিরিয়াস ছিলেন, এমনকি পথচারী হিসেবে যে মানুষটিকে কয়েক সেকেন্ড দেখা গেছে, তিনিও!
লোকেশনের কথা না বললেই নয়। পানি জমে থাকা এবড়োখেবড়ো রাস্তা দেখে একটিবারের জন্য মনে হয়নি বানানো। বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃশ্যে সেই চিরচেনা এফডিসির প্যাঁচানো সিঁড়ি না দেখিয়ে পরিচালক একটা কাজের কাজ করেছেন বটে। ঘটনা-অঘটনায় বারবার ফেসবুক লাইভে আসার মতো সমসাময়িক বিষয়গুলোও সুন্দরভাবে উঠে এসেছে। সিনেমাটোগ্রাফি ছাড়াও আলাদাভাবে দর্শকের মন কাড়বে এই ছবিতে ব্যবহৃত আবহসংগীত।
বাপ্পা মজুমদার নামের প্রতি সুবিচার করেছেন এই বাণিজ্যিক ছবিতেও। গোটা চারেক জমাটি গান মনে ধরেছে। বাপ্পা মজুমদারের কণ্ঠ শোনা গেল ভিন্নধারার গান, তাঁর স্টাইলের বাইরে। ‘আমিই বাংলাদেশ’ শিরোনামের গানটিকে সিনেমার থিম সং বলা যায়। নায়ক-নায়িকার প্রেম শুরুর সাক্ষী ইমরান-কোনালের গাওয়া ‘সুরমা সুরমা লাগে’ রোমান্টিক গানটি ছবির শেষে দর্শকদেরও গাইতে শোনা গেছে। সব মিলিয়ে ঈদে সপরিবার দর্শককে প্রেক্ষাগৃহে টানতে কোনো মসলা কম রাখেননি পরিচালক।
এবার একটু মন্দে যাওয়া যাক। শুরুতে নায়ক-নায়িকার মধ্যে একটা বিভাজনরেখা ছিল, যার একদিকে ভালো, অন্যদিকে মন্দ। অথচ গল্প এগিয়ে নিতে বিরতির আগেই তাড়াহুড়া করে দুজনের মধ্যে ভাব জমে উঠল, একলহমায় নায়িকা বদলে গেলেন! সংগত কারণেই ছবির পরিণতি নিয়মিত দর্শকদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ছবিজুড়ে কৌতূহল সমানভাবে বজায় থাকেনি। রাগ করে নায়িকার নায়কের বাবার বাড়িতে আসা, নায়িকার বাবাকে নায়কের টাকা ফিরিয়ে দেওয়া, বাবার আকুতি ইত্যাদি কিছু দৃশ্য অতীতের ঢাকাই ছবির চেনা দৃশ্যগুলোকে মনে করিয়ে দেয়। কিছু জায়গায় অতিনাটকীয়তার ছাপও স্পষ্ট।
‘লিডার: আমিই বাংলাদেশ’–এ আরেকটি ভালো বিষয় ছিল ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয়শিল্পীদের অভিনয়। সবাই সিরিয়াস ছিলেন, এমনকি পথচারী হিসেবে যে মানুষটিকে কয়েক সেকেন্ড দেখা গেছে, তিনিও!
পরিচালক শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমান গতি ও নির্মাণকে গুরুত্ব দিলে হয়তো ‘লিডার: আমিই বাংলাদেশ’ আরও উপভোগ্য হয়ে উঠত। তবু ঢাকাই বাণিজ্যিক ছবিতে নতুনভাবে গল্প বলা এবং শাকিব খানকে ভিন্নভাবে উপস্থাপনের জন্য পরিচালক তপু খানকে ধন্যবাদ।