বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, দেশের সর্বোচ্চ বিচারঙ্গণের আইনজীবীদের মর্যাদাও ধূলোয় লুটিয়ে দিয়েছে সরকার।
অবিলম্বে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচন বাতিল করে পুনর্নির্বাচনের দাবি জানিয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব বলেন, রাজসিংহাসন দখলে রেখে অনন্তকাল অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকার অসৎ অভিপ্রায়ে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান, আইন আদালত, পুলিশ, সিভিল প্রশাসন সবকিছু মুঠোয় পুরে দুমড়ে-মুচড়ে ফেলেছে।দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে পাঠিয়েছে কবরে। যেখানেই ভোট, সেখানেই আওয়ামী ভোট ডাকাত— সেখানেই সন্ত্রাস! দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবীদের সংগঠনও তাদের কালো থাবায় বিপর্যস্ত। এভাবে চলতে থাকলে দেশকে ভয়ানক গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে। সরকারের হাতের মুঠোয় রয়েছে ধ্বংসের শক্তি।
মঙ্গলবার (১২ মার্চ) দুপুরে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, লণ্ডভণ্ড নির্বাচনী ব্যবস্থা ও পেশিশক্তির উন্মত্ততার হিংস্র প্রতিফলন দেশের জনগণ অবলোকন করলেন সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনেও। রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে রাখতে আওয়ামী লীগ যেসব কূটকৌশল অবলম্বন করছে তার সবকিছুই তারা সদ্য সমাপ্ত সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি নির্বাচনে প্রয়োগ করেছে। অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি নির্বাচনে নজিরবিহীন ভোট জালিয়াতি, কারচুপি, আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সাথে যুবলীগের কামড়া—কামড়ি, হাঙ্গামা, সংঘর্ষ, অস্ত্রের মুখে যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশের স্ত্রী স্বতন্ত্র প্রার্থী নাহিদ সুলতানা যুথিকে সম্পাদক পদে নির্বাচিত ঘোষণা, পরে আবার শেখ হাসিনা ও মেয়র তাপসের প্রার্থীকে সম্পাদক পদে বিজয়ী ঘোষণার মাধ্যমে দেশের সর্বোচ্চ আইনঙ্গনের আইনজীবীদের মর্যাদা ধুলোয় লুটিয়ে দিয়েছে। ওরা হিংসা—প্রতিহিংসার পথে দেশের রাজনীতিকে উপসংহারহীন পরিস্থিতির দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে।
রিজভী বলেন, এই ভোট জালিয়াতি ও নিজেদের অপকর্মের ঘটনা থেকে মানুষের দৃষ্টি সরাতে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য প্যানেলের সম্পাদক প্রার্থী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজলকে সম্পূর্ণ পূর্ব-পরিকল্পিত মিথ্যা সাজানো মামলায় গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। ফলাফল গণনা নাটকের নামে জালিয়াতি করে ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজলকে হারিয়ে শেখ হাসিনা ও যুবলীগের চেয়ারম্যান পরশের আপন ভাই মেয়র তাপসের প্রার্থী শাহ মঞ্জুরুল হককে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্বাচনে যার সেক্রেটারি নির্বাচিত হওয়ার কথা তাকে পুরা হয়েছে জেলে! আর যার নিশ্চিত পরাজিত হওয়ার কথা তাকে শেখ হাসিনার নির্দেশে বসানো হয়েছে সম্পাদকের চেয়ারে। ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজলকে যে মামলায় আটক করা হয়েছে সেই মামলায় এক নম্বর আসামি যুবলীগের চেয়ারম্যানের স্ত্রী নাহিদকে গ্রেপ্তার তো দূরের কথা তার নাম নিতেও ভয় পাচ্ছে পুলিশ।
তিনি বলেন, গতকাল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান বলেছেন, যুথীকে খুঁজে পাচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অথচ মামলার পর সেই রাতেই বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার ওসমান চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আর যুথীকে খুঁজে পাবে কীভাবে? অ্যাডভোকেট যুথী হয়ত গণভবনেই অবস্থান করছে। পুলিশ শুধু বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে মামলার আগেই খুঁজে গ্রেপ্তার করে। না পেলে বিএনপি নেতাদের মা—বাবা—স্ত্রী—সন্তান পরিবারের সদস্যদের তুলে নিয়ে যায়। ২০ জনের নামে করা এজাহারে যুথী শুধু এক নম্বর আসামি—ই নয়, দৃশ্যমান আক্রমণকারীদের একজন পৃষ্ঠপোষক। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সিসি ক্যামেরার ভিডিওতে ঘটনার সবকিছু ধারণ করা আছে।
তিনি আরও বলেন, অথচ মামলার পরদিন গ্রেপ্তার করা হয় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক কাজলকে। পরশ—তাপস দুই ভাইয়ের মারামারি এবং পারিবারিক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব সামাল দিতে এবং সম্পাদক পদ দখলের জন্য কারারুদ্ধ করা হয়েছে কাজলকে। এত সহিংস ঘটলেও বিচারপতিরা নিশ্চুপ।
রিজভী বলেন, অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ২০২২ ও ২০২৩ সালের সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের কলঙ্কজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছে আওয়ামী দুর্বৃত্তরা। ব্যাপক জনপ্রিয় ও অধিকার আদায়ে সোচ্চার হওয়ার কারণে ব্যারিস্টার কাজলকে তাদের ভয়। ২০২২ সালে নির্বাচনে সম্পাদক পদে কাজল বিজয়ী হলেও নির্বাচনের ৪২ দিন পর সমিতির তিন তলায় অবস্থিত কনফারেন্স রুম ভেঙে পুলিশ ও বহিরাগতদের সহায়তায় তথাকথিত ভোট পুনঃগণনার নামে সম্পাদক পদে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয় এবং সম্পাদক অফিস জবরদখল করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৩ সালের ১৫ ও ১৬ মার্চ নির্বাচনের সময়ও পুলিশ ও বহিরাগতদের দিয়ে বিএনপির প্রার্থী, ভোটার, সাংবাদিকদের বেধড়ক মারধর করে ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দিয়ে পুনরায় সমিতি নিজেরা জবরদখল করে রাখে।
বিএনপির ওই নেতা বলেন, অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় এই যে, নানা অনিয়ম ও আওয়ামী লীগের প্রকাশ্য জাল—জালিয়াতির মাধ্যমে ভোটগ্রহণের পর ৮ মার্চ ভোরে অডিটোরিয়ামের ভেতরে ঘটা নৈরাজ্য ঘটনা আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থী শাহ মঞ্জুরুল হক ও নাহিদের সমর্থকদের মধ্যে সংঘটিত হলেও এ ঘটনায় জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য প্যানেলের সম্পাদক প্রার্থী কাজল ও আরও তিনজন আইনজীবী নেতাকে আসামি করে শাহবাগ থানায় একটি ফৌজদারি মামলা দায়ের করার পরই তাদের বাড়িতে/চেম্বারে হানা দেওয়া হয়। এমন আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়েছে যে, অনেক আইনজীবী সুপ্রিম কোর্টে যেতে পারছেন না। এমন একটা ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ২০২২ এবং ২০২৩ সালের সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি নির্বাচন ও সদ্য সমাপ্ত ঢাকা আইনজীবী সমিতি নির্বাচনের ন্যায় নিজেদের পছন্দমতো ব্যক্তিদের নাম বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। আমরা সব সময় বলে আসছি যে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের ছত্রছায়ায় দেশের কোথাও কোনো অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না, জনগণের ভোটাধিকারে বিশ্বাসী নয়, বিগত ২০১৪, ২০১৮ এবং ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও বিভিন্ন স্তরের স্থানীয় নির্বাচনে ইতোমধ্যে তা বার বার প্রমাণিত হয়েছে। সর্বশেষ প্রমাণ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন।
এর আগে ঢাকা আইনজীবী সমিতি নির্বাচনেও একই ধরনের প্রহসনের নির্বাচন করা হয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা ছিল, দেশের সাধারণ মানুষের আইনের আশ্রয় নেওয়ার শেষ ভরসাস্থল, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের সমিতিতে তারা নগ্ন হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকবে। কিন্তু আওয়ামী প্রভুত্ববাদের অধীনতা থেকে মুক্তির সন্ধান একদিন মিলবেই। এ পরিস্থিতিতে আমি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল—বিএনপির পক্ষ থেকে এই নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখান করছি এবং অবিলম্বে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির তথাকথিত নির্বাচনী ফলাফল বাতিল করে নির্বাচনের নতুন তারিখ ঘোষণা করতে হবে।
একইসঙ্গে দলের পক্ষ থেকে ব্যারিস্টার কাজল এবং ব্যারিস্টার ওসমান চৌধুরীসহ গ্রেপ্তার করা বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীদের নিঃশর্ত মুক্তি, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও রিমান্ড বাতিলের জোর আহ্বান জানাচ্ছি।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরী বলেন, সুপ্রিম কোর্ট বার নির্বাচনের ফলাফল আওয়ামী লীগের পূর্ব-নির্ধারিত। একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে এমন নির্বাচনে ক্ষমতাসীনরা হস্তক্ষেপ করেছে। সম্পাদক প্রার্থী কাজল কেন মামলার আসামি হবেন? আমরা এই নির্বাচনকে প্রত্যাখান করছি এবং অবিলম্বে নতুন নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি। আমাদের প্যানেলের যিনি সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন তিনিও নতুন নির্বাচন চেয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবদিন, নিতাই রায় চৌধুরী, আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, বদরুদ্দোজা বাদল, অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আলীসহ সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বী কয়েকজন প্রার্থী।