শেরপুরের নকলা উপজেলার সাংবাদিক শফিউজ্জামান রানা। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) অফিসে তথ্য চাইতে গিয়ে ছয় মাসের কারাদণ্ডের শিকার হন তিনি।ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে তাকে গালমন্দও করা হয়। ঘটনাগুলো ঘটে ওই সাংবাদিকের ছেলে দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া জামান মাহিনের (১৫) চোখের সামনে।
জামান মাহিন ওই ঘটনার বর্ণনা দেন এভাবে— ‘তখন আমার খুব ভয় করছিল। ভয়ে আমি কিছু বলতে পারছিলাম না। ভয়ে আমার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না’ এ ছাড়া তাকেও ইউএনও গালাগাল করেন বলে অভিযোগ করেন মাহিন। গত মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে নকলার ইউএনও কার্যালয়ে এ ঘটনা ঘটে।
শফিউজ্জামান রানাকে কারাদণ্ড দেওয়ার ঘটনায় সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন এবং নেতারা নিন্দা ও উদ্বেগ জানিয়েছেন। পাশাপাশি রানার নিঃশর্ত মুক্তি এবং এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়েছে।
ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে বাবাকে কারাদণ্ড দেওয়ার মুহূর্তের বর্ণনা দিতে গিয়ে মাহিন বলে, ‘তিন ভাইয়ের মধ্যে আমিই বড়। আমার ছোট ইমাম মাহাদী সে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ালেখা করে। তার ছোট দুই মাস বয়সের মাসুম। বাবা-মার বড় ছেলে হওয়ার কারণে মাঝেমধ্যেই বাবার সঙ্গে বিভিন্ন কাজে বাইরে যেতে হয়। সেই দিনও ছিলাম তার (সাংবাদিক রানা) সঙ্গে। বাবার সঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে যাই। সেই সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাদিয়া উম্মুল বানিন ছিলেন না। তিনি (উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা) দাপ্তরিক একটি আলোচনায় ছিলেন। এ সময় বাবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের গোপনীয় শাখার অফিস সহকারী (সিএ) শীলা আক্তারের কাছে তথ্য চেয়ে একটি আবেদন জমা দেন। তিনি বাবাকে অপেক্ষা করতে বলেন। আমরা দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করি। পরে বাবা আবারও ওই অফিস সহকারীকে আবেদনটি নিয়ে প্রাপ্তি স্বীকারপত্র দিতে বলেন। তখন গোপনীয় শাখার অফিস সহকারী (সিএ) শীলা আক্তার দাপ্তরিক আলোচনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রাপ্তি স্বীকারপত্র দেওয়া যাবে না বলে জানিয়ে দেন। সেই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেন। পরে বাবা কাকে যেন (সম্ভবত) জেলা প্রশাসককে ফোনে এই ভোগান্তির বিষয়টি জানান। এই বিষয়টি শীলা দাপ্তরিক আলোচনার কক্ষে ঢুকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানিয়ে দেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাদিয়া উম্মুল বানিন দাপ্তরিক আলোচনা শেষ না করেই সেই কক্ষ থেকে বের হয়ে আসেন। ’
ইউএনও সাদিয়া উম্মুল বানিন এসেই তার বাবাকে (সাংবাদিক রানা) গালাগাল শুরু করেন জানিয়ে মাহিন বলে, ‘একপর্যায়ে তিনি (ইউএনও) আমাকে বলেন, “তুইও কি বাপের মতো চোর সাংবাদিক হবি”। পরে তিনি পুলিশে খবর দেন। পুলিশ এসে বাবাকে আটক করে। পরে ইউএনওর নির্দেশে উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি মো. শিহাবুল আরিফ ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে বাবাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন। এ সময় বাবার মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয়। ’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে মাহিন আরও বলে, ‘তখন আমার খুব ভয় করছিল। ভয়ে আমি কিছু বলতে পারছিলাম না। মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না। আমার খুব কান্না পাচ্ছিল। মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে আমার বাবাকে সাজা দেওয়া হয়েছে। সেই সাজা প্রত্যাহার করে বাবার মুক্তি চাই। ’
এ প্রসঙ্গে মানবাধিকারকর্মী জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, ‘১৮ বছরের নিচে সব মানবসন্তানই শিশু। একজন শিশুকে নকলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গালাগাল করে আন্তর্জাতিক শিশু আইন পরিপন্থী কাজ করেছেন। এটা বাংলাদেশ শিশু সনদ আইনবিরোধী। আমি এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। ’
ওই পরিস্থিতিতে শিশু মাহিনকে গালাগালের ঘটনা মানসিক নির্যাতনের মতো অপরাধের সমতুল্য এবং এ ঘটনায় ওই ইউএনওর বিরুদ্ধে মামলা করা যায় বলেও মনে করেন এই মানবাধিকারকর্মী। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে ইউএনও সাদিয়া উম্মুল বানিনের মোবাইল ফোনে কল করে কোনো সাড়া মেলেনি।
শেরপুরের জেলা প্রশাসক আবদুল্লাহ আল খাইরুম বলেন, ‘পিতা যেমনই হোক, সন্তানের কাছে পিতার সম্মান সত্যিকার অর্থেই অনেক বড়। ওই ঘটনার সময়ে আমি শেরপুরে ছিলাম না, ঢাকায় ডিসি সম্মেলনে ছিলাম। যদি থাকতাম হয়তোবা এমনটা হতো না। আমার কাছে আপিলের সুযোগ আছে। রানার পরিবার আপিল করলে সেক্ষেত্রে আমি জামিনের বিষয়টা বিবেচনা করব। ’
ইউএনওর কাছে তথ্য অধিকার আইনে তথ্য চাওয়ার জেরে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে সাংবাদিক শফিউজ্জামান রানাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ তার পরিবারের। গত মঙ্গলবার উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. শিহাবুল আরিফ পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত এ দণ্ডাদেশ দেয়। স্ত্রী বন্যার দাবি, জাইকার কয়েকটি প্রকল্পের ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ের তথ্য চেয়ে তথ্য অধিকার আইনে সম্প্রতি ইউএনও কার্যালয়ে আবেদন করেন রানা। এসব প্রকল্পের তথ্য চাওয়ায় রানার ওপর ক্ষুব্ধ হন ইউএনও।
অবশ্য ইউএনও সাদিয়া উম্মুল বানিনের ভাষ্য, রানা তথ্য চেয়ে আবেদন করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তখনই তথ্য চান। তবে তথ্য দেওয়ার জন্য হাতে ২০ দিন সময় আছে বলে রানাকে জানান। তখন গোপনীয় সহকারীর (সিএ) কাছে থাকা ওই তথ্যের ফাইল টানাটানি শুরু করেন রানা। তিনি অসদাচরণ করে অফিসের পরিবেশ নষ্ট করেছেন। তাই তিনি সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে বলেছেন।
রানার মুক্তি ও দোষীদের শাস্তি দাবি
সাংবাদিক রানার মুক্তি দাবি জানিয়েছেন বরিশালের সাংবাদিকরা। একই সঙ্গে তাকে কারাদণ্ড দেওয়ার ঘটনায় নকলার ইউএনওর অপসারণ দাবি করেছেন তারা। শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত বরিশাল প্রেস ক্লাব, বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটি, বরিশাল সাংবাদিক ইউনিয়ন, বরিশাল নিউজ এডিটরস কাউন্সিল, বরিশাল তরুণ সাংবাদিক ফোরাম, বরিশাল ফটোসাংবাদিক পরিষদ এবং বরিশাল অনলাইন প্রেস ক্লাবের পক্ষ থেকে এ দাবি জানানো হয়েছে।
শফিউজ্জামান রানাকে জেলে পাঠানোর ঘটনায় উদ্বেগ এবং তার নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেছে নোয়াখালী প্রেস ক্লাব এবং ইয়ুথ জার্নালিস্ট ফোরাম, নোয়াখালীর নেতারা। একই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নীলফামারী প্রেস ক্লাব, সৈয়দপুর প্রেস ক্লাব এবং নীলফামারী জেলা রিপোর্টার ইউনিটির নেতারা।
শফিউজ্জামান রানার মুক্তি দাবি করেছেন দিনাজপুরের সাংবাদিকরা। একই দাবি জানিয়েছেন জেলার ফুলবাড়ী রিপোর্টার্স ইউনিটির নেতারা।
রানার মুক্তি দাবিতে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছেন নাটোরের সাংবাদিকরা। তার মুক্তি এবং নকলার ইউএনওকে অপসারণসহ বিচার দাবি করেছেন লালমনিরহাটের সাংবাদিকরা। একই ঘটনায় উদ্বেগ ও প্রতিবাদ জানিয়ে নকলার ইউএনওর অপসারণ এবং বিচার দাবি করেছেন মেহেরপুরের সাংবাদিকরা।
সাংবাদিক রানাকে কারাদণ্ডের ঘটনায় উদ্বেগ ও প্রতিবাদ জানিয়েছে ফেনীর সাংবাদিক সংগঠন ছাড়াও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ফেনী শাখা। এ ছাড়া রানাকে কারাদণ্ডের ঘটনায় উদ্বেগ ও প্রতিবাদ জানিয়ে নকলার ইউএনওর অপসারণ এবং বিচার দাবি করে বিবৃতি এবং বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ, চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও আনোয়ারা এবং ময়মনসিংহের গৌরীপুরের বিভিন্ন সাংবাদিক ও সামাজিক সংগঠন।