আ. লীগ আমলে অনিয়মের মাধ্যমে দেওয়া ঋণগুলোই হয়ে যাচ্ছে ‘খেলাপি’

আ. লীগ আমলে অনিয়মের মাধ্যমে দেওয়া ঋণগুলোই হয়ে যাচ্ছে ‘খেলাপি’

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনিয়মের মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণগুলো এখন একে একে খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। এতে করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মানলে সামষ্টিক খেলাপি ঋণের পরিমাণ পাঁচ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে—এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।ফলে বাড়ছে আর্থিক খাতের এই নেতিবাচক সূচক।  

সংস্থাটি খেলাপি ঋণের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনার পরামর্শ দেওয়ায় এবং ঋণ পুনঃ তফসিলের নীতিমালাকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করার পরামর্শের কারণে এই ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।  

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, শুধু এক জায়গায় টাইট দিয়ে অর্থনীতিকে ঠিক করা যাবে না। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও উৎপাদন ঠিক রাখতে যে ধরনের নীতিমালা প্রয়োজন সেগুলো নিতে হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্র বলছে, ঋণ শ্রেণীকরণ নীতিমালা আরো কঠোর করতে বলেছে আইএমএফ। এছাড়া সংস্থাটি বলছে, খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিল সুবিধা নেওয়ার পরপরই সেই ঋণ নিয়মিত দেখানো যাবে না।

দ্রুত এসব বিষয় সংশোধন করে প্রজ্ঞাপন জারির পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিল সুবিধা নেওয়ার পর ব্যাংকগুলো ওই ঋণটি সঙ্গে সঙ্গে নিয়মিত দেখায়। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক চর্চা অনুসরণ করা হচ্ছে না। তাই দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্যাসেল-৩ নীতিমালার আলোকে সংশোধন করে প্রজ্ঞাপন জারি করতে বলেছে আইএমএফ।

ব্যাসেল-৩ নীতিমালা অনুযায়ী, খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিল সুবিধা নিলেও ওই ঋণ তিন মাসের আগে নিয়মিত দেখাতে পারবে না। এই তিন মাস গ্রাহক ঠিকমতো ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারলে ঋণ নিয়মিত দেখাতে পারবে। কিন্তু দেশের ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিল করার সঙ্গে সঙ্গে ঋণটি নিয়মিত দেখাচ্ছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ শ্রেণীকরণ নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত নীতিমালার প্রশংসা করেছে সংস্থাটি। ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে কোনো ঋণ পরিশোধ না করলে তা মেয়াদোত্তীর্ণ হিসেবে গণ্য হবে।

এরপর অনাদায়ি হিসেবে ওই ঋণ ৯০ দিন অতিক্রম করলে খেলাপি হয়ে যাবে।
জানা গেছে, আইএমএফের সঙ্গে কয়েক দফায় আলোচনা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত নীতিমালা চূড়ান্ত করে। পাশাপাশি আগামী জুনে এই নীতিমালা অনুযায়ী প্রতিবেদন তৈরিতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ব্যাংকগুলো তিন মাস ভিত্তিতে ঋণের মানসংক্রান্ত প্রতিবেদন তৈরি করে থাকে। ফলে এপ্রিল থেকে এই নীতিমালা কার্যকর হতে পারে। এই নীতিমালার কারণে ব্যাংক খাতে খেলাপি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগের সহযোগী ব্যবসায়ীদের দেওয়া ঋণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় গত সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ রেকর্ড দুই লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। এ ছাড়া অবলোপনকৃত ঋণ ৬০ হাজার কোটি, অর্থঋণ আদালতে আটকা দুই লাখ ৭৮ হাজার কোটি।

আদালতে রিট করার মাধ্যমে স্টে অর্ডার নেওয়া ৭৬ হাজার কোটি টাকাও আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী খেলাপির খাতায় যুক্ত হবে। তাই আগামী বছর প্রকৃত হিসাবায়ন করলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ পাঁচ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, ‘আগের সরকারকেও ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছিল আইএমএফ, কিন্তু তারা সেটা করেনি। বর্তমান সরকার বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। আন্তর্জাতিক নীতিমালা বাস্তবায়ন করা হলে ব্যাংকের ভিত্তি শক্ত হয়। যেমন—আমাদের চেয়ে অনেক দুর্বল অর্থনীতির দেশ হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের ব্যাংকিং সেক্টরের ভিত্তি অনেক শক্ত। আমাদেরও ধীরে ধীরে সেদিকেই যেতে হবে। ’

তিনি আরো বলেন, ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়নের ফলে নতুন করে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পাবে না। কারণ এগুলো আগে থেকেই খেলাপি হয়ে আছে। এখন এগুলোকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। এর ফলে অর্থনীতিতে কোনো ক্ষতিকর প্রভাবও পড়বে না বলে মত এই ব্যাংকারের।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছে সেগুলো ভালো, কিন্তু তাদের সব শর্ত যে সব দেশ মানতে পারবে এমন তো কোনো কথা নেই। আমাদের দেশের হাজার জায়গায় হাজার সমস্যা। শুধু এক জায়গায় টাইট দিয়ে অর্থনীতিকে ঠিক করা যাবে না। আর অর্থনীতি ঠিক করার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের একার নয়। তাই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও উৎপাদন ঠিক রাখতে যে ধরনের নীতিমালা প্রয়োজন সেগুলো নিতে হবে। ’

তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের দেশের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্সে ঘাটতি, ফিন্যানশিয়াল অ্যাকাউন্টে ঘাটতি। এখন নীতিমালা আরো কঠিন করলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারো কথায় হুট করে আইন জারি না করে অর্থনীতির অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ এই ব্যবসায়ীর।

প্রসঙ্গত, আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ কর্মসূচির পরবর্তী কিস্তি ছাড়ের আগে বিভিন্ন শর্ত পর্যালোচনায় একটি টিম দেশে এসেছে। তারা বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগসহ (ইআরডি) বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করছে। এই ঋণ কর্মসূচি চলাকালে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে। এরই মধ্যে আর্থিক খাত সংস্কারে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে নতুন সরকার। ওই ঋণের চতুর্থ কিস্তির জন্যই এসব শর্ত নতুন করে মনে করিয়ে দিচ্ছে সংস্থাটি।

গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের গবেষণা ফেলো এম হেলাল আহমেদ জনি বলেন, ‘বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আইএমএফের পরামর্শ মেনে খেলাপি ঋণের হিসাব পদ্ধতিতে কিছুটা পরিবর্তন করা যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ পাওয়ার পর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হতে পারে। কারণ ব্যাসেল-৩ নীতিমালা অনুযায়ী ব্যাংকগুলোকে পর্যাপ্ত মূলধন রাখতে হবে এবং এর ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে, যেটি বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেশ কঠিন। এসব বাস্তবায়নে সময় দিতে হবে। তবে এটি বাস্তবায়ন করা গেলে ভবিষ্যতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমে যাবে এবং সমস্যা চিহ্নিত করা সহজ হবে। ’

তিনি আরো বলেন, এই নীতিমালা যেমন তাৎক্ষণিক বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়, তেমনি এখনই ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভাব বিস্তারের সম্ভাবনা নেই।

ব্যবসা সম্পর্কে তিনি জানান, ব্যবসা-বাণিজ্যে ধীরগতির অনেক কারণ আছে। প্রথমত, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে গত ১৬ বছরে যেসব ব্যবসায়ী বিভিন্ন সেক্টরে নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা কোনো কারণে আগের মতো মুভ করতে পারছেন না। তাদের সেই জায়গায় রাতারাতি পরিবর্তন এসেছে। সেই কারণে তারা এখনো পুরোপুরি পারফর্ম করতে পারছেন না। দ্বিতীয়ত, নির্বাচিত সরকার না থাকায় অন্য দেশের সঙ্গে স্বাভাবিক ব্যবসা-বাণিজ্যে কিছুটা সংশয় পরিলক্ষিত হচ্ছে। তা ছাড়া দেশ অস্থিতিশীল এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের অনুকূল পরিবেশ নেই—এমন প্রচারণাও বিরোধী রাজনীতিকদের পক্ষ থেকে জোরদার করা হচ্ছে। সার্বিকভাবে ব্যবসায় আস্থা ফেরাতে উল্লেখযোগ্য কিছু কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে, যাতে সবার অংশগ্রহণ বাড়ে এবং সরকারের প্রতি আস্থা তৈরি হয়।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023 EU BANGLA NEWS