প্রায় ১২ লাখ টাকা খরচ করে দালালের মাধ্যমে বিদেশে যান আসাদ শেখকে (৩০)। কিন্তু সেখানে গিয়ে পাননি কোনো কাজ।টাকা ফেরত চাওয়ায় আসাদ শেখকে (৩০) হুমকি দেওয়া হয়। এরপর বিদেশ থেকে ফিরে দালালদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করলে মামলা তুলে নিতেও দেওয়া হয় হুমকি। অথচ বিদেশে কর্মসংস্থানের আশায় ধারদেনা করে টাকা জোগাড় করে তুলে দিয়েছিল দালালের হাতে। এখন বসতভিটা ও জায়গাজমিসহ অন্যান্য সহায় সম্পদ হারিয়ে আসাদের পরিবারটি নিঃস্ব হয়ে গেছে।
আসাদ শেখে ফরিদপুর সদর উপজেলার ঈশান গোপালপুর ইউনিয়নের গনি শিকদার পাড়া গ্রামের আনছার শেখের ছেলে। পেশায় একজন ইটভাটা শ্রমিক। ইটভাটায় দিনমজুরের কাজ করতে যেয়ে পরিচয় হয় পাশের গ্রাম মোমিনখাঁর হাটের মোমিরখাঁর হাটের মৃত সামাদ শেখের ছেলে আতিয়ার শেখের সঙ্গে। এ সময় তাকে লিবিয়ায় মাসে ৫০ হাজার টাকা বেতনে ভালো চাকরির প্রলোভন দেখায় আতিয়ার। প্রথম দফায় সাড়ে চার লাখ টাকা নিয়ে ২০২২ সালের ২৫ নভেম্বর আসাদকে ভিজিট ভিসায় দুবাই নিয়ে যায়। পরের মাসে ৬ ডিসেম্বর তাকে লিবিয়ার বেনগাজীতে নিয়ে অজ্ঞাতস্থানে আটকে তার পরিবারের কাছে ফোনে মুক্তিপণ দাবি করা হয়।
আসাদ বলেন, সেখানে তাকে শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন করা হতো। একপর্যায়ে তাকে লিবিয়ায় কাজ নেই বলে ইতালি পাঠিয়ে দেওয়া হবে বলে আরও টাকা আনতে বলে দেশ থেকে। নিরুপায় হয়ে এরপর প্রথমে দুই দফায় ৯০ হাজার ও ৯৩ হাজার টাকা পাঠানো হয় তাদের কাছে। এরপর বসতবাড়ি বিক্রি করে আরও পাঁচ লাখ টাকা দেওয়া হয় তাদের। তারপরেও তাকে আকামা জোগাড় করে দেয়নি তারা।
আসাদ জানান, লিবিয়া নিয়ে তাকে দুই মাসের ট্যুরিস্ট ভিসায় ক্লিনারের কাজে পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানে ৯ মাসের কাজের টাকাও তারা আটকে রাখে। একপর্যায়ে আকামা না থাকায় তাকে আটক করে লিবিয়ান পুলিশ। এরপর দালালের মধ্যস্থতায় ছাড়া পেয়ে ২০২৩ সালের অক্টোবরের দিকে কোনোমতে জান নিয়ে দেশে ফিরে আসেন।
এ ঘটনায় আসাদ দেশে ফিরে মানবপাচার মনিটরিং সেলে অভিযোগ দায়েরের পর ফরিদপুরের চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন। মামলায় আতিয়ার শেখ (২৯) ও তার সহযোগী সিরাজগঞ্জের সলঙ্গার আমীর হোসেনের ছেলে হান্নান শেখকে (৪২) আসামি করা হয়। তবে মামলা দায়েরের পর উল্টো তাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়।
আসাদ শেখের বাবা আনসার শেখ বলেন, জমি বন্ধক রেখে ধারদেনা করে ছেলেকে বিদেশে পাঠাই। তারপর মুক্তিপণের জন্য বসতভিটাও বিক্রি করে দেই। আমিতো বাড়িঘর সব হারাইছি। লাখ লাখ টাকা দিছি আতিয়াররে। আমি আমার টাকা ফেরত চাই।
জানা গেছে, আদালতের নির্দেশে ফরিদপুর পিবিআই মামলাটি তদন্ত করে। তদন্তকালে আতিয়ার ও হান্নানের বিরুদ্ধে সাড়ে চার লাখ টাকা নিয়ে অবৈধভাবে বিদেশে পাঠানো, তারপর সেখানে আটকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে মুক্তিপণ আদায়, পরে লিবিয়া থেকে ফেরত পাঠানোর অভিযোগের সত্যতা মিলেছে বলে আদালতে দাখিলকৃত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা এএসআই মো. শহিদুল ইসলাম।
তদন্ত কর্মকর্তা জানান, আসাদকে সাড়ে চার লাখ টাকা নিয়ে লিবিয়া পাঠানোর পর মুক্তিপণ হিসেবে আসাদের পরিবারের কাছ থেকে আরও পাঁচ লাখ টাকা ও কয়েকটি ব্যাংকের চেকের মাধ্যমে আরো ১ লাখ ৮৩ হাজার টাকা প্রতারণা করে হাতিয়ে নেওয়ার সত্যতা পাওয়া গেছে। আদালত তদন্ত প্রতিবেদন আমলে নিয়ে মামলার বিবাদীকে আদালতে হাজিরের জন্য সমন জারি করেন গত জুলাই মাসে। ৩১ অক্টোবর মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য রয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে আতিয়ার শেখের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুবাই থেকে সাধারণত মিশর কিংবা সিরিয়ায় ট্রানজিট দেওয়া হয়। তবে আসাদকে বেনগাজীতে নামানো হয়। চার লাখ টাকায় আসাদকে লিবিয়া নেওয়ার কথা ছিলো। তবে তাকে লিবিয়া পাঠাতে তার সাড়ে পাঁচ লাখ টাকার মতো খরচ হয়। এজন্য তার কাছ থেকে এক লাখ টাকা ধারও দেন তিনি। তবে লিবিয়ায় আসাদকে একবছরের ভিসা দিয়ে কাজেও পাঠানো হলেও সে ভেজাল করে চলে আসে।
আতিয়ার বলেন, আসাদকে লিবিয়া বিমানবন্দর হতে সরাসরি ক্যাম্পে নেওয়া হয়। তার দু’দিন পরেই তাকে এক বন্ধুর মাধ্যমে একটা কফি হাউজের কাজে লাগায় দিয়েলাম। সেই কাজ সে করেনি। পরে তাকে রোড ক্লিনারের কাজ দেওয়া হয়। সেখানে সে কয়েকদিনের টাকা পাওনা পেতো। আসাদের পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ বাবদ ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা নেওয়ার কথা তিনি জানেন না এবং বিদেশে যাওয়ার পরে আসাদের মামার মাধ্যমে তাকে আগের পাওনার টাকা পরিশোধ করা হয় বলে তিনি দাবি করেন।
জানা গেছে, এর আগে আতিয়ার লিবিয়ায় কাজ করতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে দুই বছর আগে ফিরে আসেন। তবে আসাদ ছাড়া আর কাউকে তিনি বিদেশে পাঠাননি এবং সলঙ্গার হান্নানকে তিনি চিনেন না বলেও দাবি করেন। আর আসাদকে মোবাইল ফোনে দেখে নেওয়ার কোনো হুমকিও তিনি দেননি বলেও জানান। যদিও মোবাইল ফোনে হুমকির এ রেকর্ড সংরক্ষিত রয়েছে।