সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি কী, কীভাবে হতে পারে বাস্তবায়ন

সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি কী, কীভাবে হতে পারে বাস্তবায়ন

কয়েক দশক ধরেই সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বশীল নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা হলেও গত কয়েক বছরে ছোট দলগুলোর পক্ষ থেকে এ দাবি ধীরে ধীরে জোরদার হয়েছে।

প্রথমে নির্বাচন পর্যবেক্ষক পর্যায় থেকে এ আলোচনার শুরু হয়।ধীরে ধীরে রাজনৈতিক দল, এমনকি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতর থেকেও তা উজ্জীবিত হয়েছে। এখন অন্তর্বর্তী সরকারের চলমান সংস্কার কর্মসূচির মধ্যে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বশীল নির্বাচন ব্যবস্থার দাবি আবারও সামনে এসেছে। তবে বড় দল বিএনপিসহ বেশকিছু দল এর বিপক্ষে।

পৃথিবীতে সর্বাধিক প্রচলিত দুই ধরনের নির্বাচন পদ্ধতি:
পৃথিবীর ১৭০টি দেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় অর্ধেকের মতো দেশে নির্বাচন হয় সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে। যেটিকে বলা হয় প্রোপরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন বা পিআর। এই পদ্ধতিতে একটি দল যত ভোট পায়, সেই অনুপাতে জাতীয় সংসদে আসন পায়। এতে একটি নির্বাচনের পর সংসদে সব দলের ও মানুষের প্রতিনিধি থাকে। পদ্ধতির আবার তিন ধরণের ব্যবস্থা রয়েছে- মুক্ত তালিকা, বদ্ধ তালিকা ও মিশ্র ব্যবস্থার নির্বাচন।

মুক্ত তালিকায় ভোটের তফসিল ঘোষণার পর দলগুলো প্রার্থীর তালিকা প্রকাশ করে। সংশ্লিষ্ট দল যত ভোট পায় তার হার অনুযায়ী সেই তালিকায় ক্রমানুসারে আসন বণ্টন হয় সংশ্লিষ্ট দলের মধ্যে। বদ্ধ তালিকা প্রার্থীদের নাম প্রকাশ করা হয় না। আর মিশ্র ব্যবস্থায় কিছু আসনে সংখ্যানুপাতিক ও কিছু আসনে আসন ভিত্তিক নির্বাচন হয়।

অন্য নির্বাচন ব্যবস্থাটি হলো বাংলাদেশের প্রচলিত নির্বাচন ব্যবস্থা। যেটিকে ওয়েস্ট মিনিস্টার ব্যবস্থা বলা হয়। ওয়েস্টমিনিস্টার কথাটি এসেছে লন্ডনে প্যালেস অব ওয়েস্টমিনিস্টার থেকে। এখানেই ব্রিটিশ পার্লামেন্ট অবস্থিত। মূলত, ব্রিটেনের নির্বাচন ব্যবস্থাকেই ওয়েস্টমিনিস্টার সিস্টেম বলা হয়। কমনওয়েলথভুক্ত দেশ বা ব্রিটিশ শাসনাধীন ছিল যে দেশগুলো, মূলত সে সকল দেশে এ ব্যবস্থায় নির্বাচন হয়।

ওয়েস্টমিনিস্টার ব্যবস্থায় আসনভিত্তিক নির্বাচন হয়। এতে দলের ও স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকে। যে দলের যে প্রার্থী বা যে প্রার্থী সর্বোচ্চ ভোট পায় তিনিই ওই আসন থেকে সংসদের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হন। এই ব্যবস্থায় এককভাবে কোনো ব্যক্তি মোট ভোটের তুলনামূলক কম শতাংশ ভোট পেয়েও নির্বাচিত হতে পারে। যেমন একটি আসনে যদি ১০০টি ভোট পড়ে, আর সেখানে যদি তিনজন প্রার্থী থাকে, তারা যদি একজন ৩০, অন্যজন ৩০, অবশিষ্ট জন যদি ৪০ ভোট পান তাহলে তিনিই জয়ী হন। এক্ষেত্রে ৬০ জনের ভোটের কোনো প্রতিফলন থাকে না।

সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে দল ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অবস্থান:
নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪৭টি দলের মধ্যে বেশ কয়টি বড় ও পুরনো দল পিআর ব্যবস্থাকে আনার জোর দাবি তুলেছে। তবে বিএনপিসহ বেশকিছু দল এর বিপক্ষেও রয়েছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এ নিয়ে কোনো বক্তব্য এখন পর্যন্ত সেভাবে আসেনি। তবে সরকার পতনের আগে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এক সভায় ওয়েস্টমিনিস্টার ব্যবস্থাকেই সমর্থনের কথা জানিয়েছিলেন।

এদিকে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, গণ অধিকার পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলন, আমার-বাংলাদেশ বা এবি পার্টি ও জাতীয় পার্টি পিআর ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য দাবি তুলেছে। সেই সেমিনারে অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাচন সংস্কার বিষয়ক কমিশন প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সংবিধান সংস্কার বিষয়ক কমিশন যদি এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়, তার কমিশনও কিছু প্রস্তাব দেব।

এছাড়া বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলও (বাসদ) এই পদ্ধতিতে নির্বাচন চায়। দলগুলোর মধ্যে প্রথম এ দাবি তুলে সিপিবি। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে বসে ২০১৩ ও ২০১৭ সালে দলটির নেতারা এ ব্যবস্থায় যাওয়ার কথা বলে। এরপর অন্যান্য দলগুলোও এ নিয়ে অবস্থান নেয়।

দলগুলোর রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে সবচেয়ে জোরালো আওয়াজ তোলেন সম্প্রতি পদত্যাগী প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। গত ৫ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করার আগেও তিনি বলেছেন, বর্তমান ও অতীত থেকে আহরিত অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও উপলব্ধি থেকে ভবিষ্যতের জন্য কিছু প্রস্তাবনা সরকারের সদয় বিবেচনার জন্য রেখে যাওয়া কর্তব্য মনে করছি। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর সমরূপতার (হোমোজেনিটি) কারণে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক (দলীয় ভিত্তিক) নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশ আদর্শ ক্ষেত্র হতে পারে। সেই সঙ্গে নির্বাচন চার বা আটটি পর্বে, প্রতিটি পর্বের মাঝে ৩/৫ দিনের বিরতি রেখে, অনুষ্ঠান করা ব্যবস্থাপনার দিক থেকে সহজ ও সহায়ক হতে পারে।

নির্বাচন বিশ্লেষকরা যা বলছেন:
নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেছেন, ৯০-এর দশকে আমি প্রথম ভয়েস অব আমেরিকায় এ নিয়ে অনুষ্ঠানে কথা বলেছি। শাসন ব্যবস্থাকে ট্র্যাকে আনতে হলে পিআর বা সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা লাগবে। সে সময় বাসদ, জাসদ একমত হয়েছিল। সিপিবির সঙ্গেও আলোচনা হয়েছিল। ছোটদলগুলো স্বার্থ রক্ষার জন্য এ ব্যবস্থায় চেয়ে ভালো কিছু নেই।

বর্তমান যে ব্যবস্থা ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ বা এফপিটিপি। এই ব্যবস্থায় একজন এক ভোট বেশি হলে সেই নির্বাচিত হয়। আসন পায়। এতে মূলত মাইনরিটির শাসন নিশ্চিত হয়। কেননা, সবগুলো দলের আলাদা আলাদা ভোট যোগ করে ৭০ শতাংশ হলেও সরকার গঠন করতে পারে না। এক্ষেত্রে কোনো দল ৩০ শতাংশ ভোট অর্জন করলেও আসন বেশি পেয়ে ক্ষমতায় যেতে পারে। তার অর্থ হলো মাইনরিটির শাসন নিশ্চিত হয়। বর্তমানে বিশ্বের ৮০টিরও বেশি দেশে এ ব্যবস্থা চালু আছে। নেপালেও আংশিক এ ব্যবস্থা আছে। আমাদের এখানে নারী আসনে সীমিত আকারে এই ব্যবস্থা আছে।

পিআর এখন সময়ের দাবি, এটা বাস্তবায়ন করা দরকার। তবে জাতীয়ভাবে একটি ন্যূনতম শতাংশ ভোট পেতে হবে জাতীয় সংসদে আসন পেতে হলে। সেটা হতে পারে ৩ শতাংশ কিংবা ৫ শতাংশ। তবে এজন্য পূর্ণ জাতীয় ঐক্যমত থাকতে হবে।

সংবিধান সংশোধনের দরকার আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন তো নতুন করে সংবিধান লেখার কথাই বলা হচ্ছে। যদি নতুন করে লেখা হয় তাহলে তো আর সংশোধনের বিষয় আসে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ও ঢাকা ইন্টারন্যাশল ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন ব্যাপারি বলেন, পিআর সিস্টেম অনেক দেশেই আছে। রাজনীতি গঠিত হয় রাজনৈতিক অর্থনীতির ওপর। এই আলোচনার আগে আমাদের দেশের অর্থনীতি দেখতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ কিন্তু এই চিন্তা করতেই পারছে না। পশ্চিমা দেশগুলো শিল্পায়িত, তারা কিন্তু এই ব্যবস্থা করে ফেলেছে। আমরা চিন্তা করছি। কিন্তু এজন্য ১০ থেকে ১৫ বছর সময় নেওয়া প্রয়োজন। একটা গাছ যেমন একদিনে মহীরুহ হয়ে ওঠে না, তেমনি প্রতিষ্ঠানগুলোও একদিনে গড়ে ওঠে না।

তিনি বলেন, আমাদের আইন বিভাগ, শাসন বিভাগসহ সব প্রতিষ্ঠানই তো ধ্বংস হয়ে গেছে। আগে এগুলো ঠিক করতে হবে। ব্রিটেনের রাজনৈতিক বর্তমান যে ব্যবস্থা তা কিন্তু একদিনে গড়ে ওঠেনি। ধীরে ধীরে হয়েছে। তাই আগে প্রতিষ্ঠানগুলো জাগ্রত করতে হবে। পলিটিকস নিডস ইমিডিয়েট বেনিফিট। সবাই তাৎক্ষণিক সুবিধা চায়। বর্তমান সরকারের উচিত আগে দ্রব্যমূল্যে হাত দেওয়া।

অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন ব্যাপারি আরও বলেন, পিআর করতে হলে তো সংবিধান সংশোধন করতে হবে। কিন্তু এখন কী সংসদ আছে? সংসদ তো নেই। এক্ষেত্রে সংসদকে পাশ কাটিয়ে সংবিধান লঙ্ঘন করা হলে এক সময় তাদের ফাঁসি হবে। কারণ, যারা আসবে পরবর্তীতে তারা কি মানবে? তাদের দায়িত্ব হলো নিরপেক্ষ নির্বাচন দেওয়া। সেটাই করা উচিত। যদি পিআর করতেই হয়, তবে সবগুলো দলের না হলেও অন্তত বড় দলগুলোর ঐক্যমত প্রয়োজন। ঐক্যমত্যে পৌঁছতে পারলে করেন।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023 EU BANGLA NEWS