আগস্টের ৪ তারিখ। সেদিন ফেনীর এক প্রান্ত ফুলগাজী-পরশুরামে চলছিল শ্রাবণের বর্ষণ।বানের জলে ভাসছিল রাস্তা আর ঘর-বসতি। অপর প্রান্ত ফেনীর মহিপালে চলছিল গুলিবর্ষণ। সন্ত্রাসীদের সেই গুলির বৃষ্টিতে ঝরেছে ডজনখানেক তাজা প্রাণ। গুলিবিদ্ধ হয়েছে অনেক কিশোর-তরুণ। রক্তাক্ত হয়েছে জনপদ। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অবস্থান কর্মসূচিতে সেদিন অতর্কিত হামলা চালায় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের অস্ত্রধারী নেতা-কর্মীরা। তাদেরই গুলিতে খালি হয়েছে অনেক মায়ের বুক, স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হয়েছে বাবার।
এই জনপদের ইতিহাসের ন্যক্কারজনক হামলায় প্রাণ হারায় ফেনী সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী ও পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ড অচিনগাছ তলার বাসিন্দা ইসতিয়াক আহমদ শ্রাবণ, ফেনী সদর উপজেলার ফাজিলপুর ইউনিয়নের তুলাতলি এলাকার রফিকুল ইসলামের মেঝো ছেলে ছাইদুল ইসলাম শাহী, সদর উপজেলার ফাজিলপুর ইউনিয়নের কলাতলী গ্রামের রফিকুল ইসলামের ছেলে সাইদুল ইসলাম, পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ কাশিমপুর এলাকার সিরাজুল ইসলামের ছেলে ওয়াকিল আহমেদ শিহাব, সোনাগাজীর চর মজলিশপুর ইউনিয়নের মান্দারি গ্রামের দেলোয়ার হোসেনের ছেলে সাকিব, দাগনভূঞা উপজেলার জায়লস্কর ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. শাহজাহানের ছেলে সরোয়ার জাহান মাসুদ, সোনাগাজীর চরছান্দিয়া এলাকার নোমান হোসেনের ছেলে কলেজছাত্র মাহবুবুল হাসান মাছুম, লক্ষ্মীপুর জেলার মালেকের ছেলে অটোরিকশা চালক সাইফুল ইসলাম, আরাফাত ও বিপ্লব।
ফাজিলপুরে ছাইদুল ইসলাম শাহীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, টিনশেড শাহীর ঘর যেন শোকে কাঁদছে। বেদনার ভারে নিশ্চুপ পাড়া-পড়শীরাও। দিন যায়, সপ্তাহ যায়; তার মায়ের চোখের অশ্রু শুকায় না।
ঘরে শাহীর পোশাক-আসাক দেখিয়ে স্মৃতিচারণ করছিলেন মা। ছেলের পরা একটি টি-শার্টের বুকের দিকে লেখা ‘নতুন খামে পুরোনো চিঠি’ দেখিয়ে বলেন, ‘এই টি-শার্ট পরেই প্রায় সময় আন্দোলনে যেতো ছাইদুল হক শাহী। ’ ছেলের পছন্দের টি-শার্টটি নেড়ে-ছেড়ে কাঁদেন শাহীর মা। আদরের সন্তানের পরনের কাপড়গুলো নেড়ে-চেড়ে যেন গন্ধ নিতে চান, পেতে চান মায়াভরা স্পর্শ।
‘আন্দোলনে যাওয়ার সময় ছেলে সেদিন ২০ টাকা চেয়েছিল, দিতে পারিনি’, এ কথা বলতেই ঢুকরে কেঁদে ওঠেন শাহীর মা।
লেগুনাচালক হতদরিদ্র বাবা রফিকুল ইসলাম বহু কষ্টে শাহীকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়িয়েছেন, অর্থকষ্টে পড়াশোনা নিয়মিত করাতে পারছিলেন না। তার আরও দুই ছেলে থাকলেও মেঝো ছেলে শাহীর মধ্যেই পড়াশোনার আগ্রহ দেখে স্বপ্ন বুনতেন রফিকুল। ছেলেকে পড়িয়ে বড় করবেন। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন কেড়ে নিল ঘাতকের দল। ভর দুপুরে গুলি করে রাজপথে কেড়ে নিল শাহীর প্রাণ।
শাহীর দুই ভাইয়ের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, তারাও শাহীকে ভীষণ পছন্দ করতেন। সহোদরকে হারিয়ে দুই ভাইয়ের কান্নাও থামছে না। তারা জানান, ৪ আগস্টের আগে আরও দুই দিন শাহীর ওপর হামলা চালিয়েছিল এলাকার ছাত্রলীগের ক্যাডাররা।
এলাকাবাসীর ভাষ্য, তাদের দেখা সমাজের সবচেয়ে ভালো ছেলে ছিলেন ছাইদুল হক শাহী। যেমন নম্র ছিলেন তেমন ভদ্র। এলাকার সবচেয়ে ভালো ছেলেটাকেই মেরে ফেলা হলো।
এখনো ভয়ে শিউরে উঠছে মানুষ, গ্রেফতার হয়নি কেউ
৪ আগস্টের ওই বর্বরোচিত ঘটনা মনে হলে এখনো ভয়ে শিউরে উঠছে জেলার মানুষ। ঘটনার দুই সপ্তাহ পার হলেও কেউ গ্রেফতার হয়নি। যদিও মামলা হয়েছে পাঁচটি। এ ঘটনায় প্রকাশ্য অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি করার অনেক ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনামতে, ওইদিন দুপুরে ট্রাংক রোডে জেলা আওয়ামী লীগের সব পর্যায়ের নেতা-কর্মী ছাড়াও পেশাদার খুনি ও অস্ত্রধারীদের জড়ো করা হয়। দুপুর ২টার দিকে তারা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মহিপালে অবরোধকারী শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচারে গুলি করতে থাকে।
ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি করিম উল্যাহ বি.কম, জেলা যুবলীগের সহ-সভাপতি ও শর্শদী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জানে আলম ভূঞা, সাংগঠনিক সম্পাদক ও পৌরসভার ২নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর লুৎফুর রহমান খোকন হাজারী, ১৮নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন রাজন, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শুসেন চন্দ্র শীলের দেহরক্ষী তানজীম, জেলা ছাত্রলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি জিয়াউদ্দিন বাবলু, সদর উপজেলা ছাত্রলীগের শিক্ষা সম্পাদক ইমতিয়াজ ইমনকে অগ্রভাগে আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলি করতে দেখা গেছে। এছাড়া জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের বেশ কয়েকজন নেতাকে হামলার সময় দেখা গেছে।
হামলাকারীদের অনেকে মহিপালের চৌধুরী মার্কেটের দ্বিতীয় তলা ও ছাদের ওপর থেকে গুলি ছোড়ে। শত শত রাউন্ড গুলির শব্দে প্রকম্পিত হয় পুরো মহিপাল। বন্ধ হয়ে যায় দোকান-পাট। দেড় ঘণ্টার বেশি সময় ধরে গুলিবর্ষণে নিরস্ত্র আন্দোলনকারীরা যখন মারা যাচ্ছিল, তখন ইসলামপুর রোড থেকে বিএনপির নেতা-কর্মীরা বের হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু অস্ত্রধারীরা তখনো আতঙ্ক ছড়ায় শহরজুড়ে।
যদিও ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতন হলে এই অস্ত্রধারীরা গা-ঢাকা দেয়। তবে তাদের অনেকের হাতেই এখনো আগ্নেয়াস্ত্র রয়ে গেছে বলে আশঙ্কা সচেতন মহলের। সেজন্য জনসাধারণের নিরাপত্তার স্বার্থে ভিডিও ফুটেজ দেখে অস্ত্রধারীদের গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন তারা।